রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা জসিম উদ্দিন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারওয়ান বাজারে সবজির আমদানি অনেক কমে গেছে। ওই বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সবজি না পাওয়ায় দাম ক্রমেই বাড়ছে। আগে আমরা যে সবজি একজনে কিনতাম, এখন আমদানি কম থাকায় আড়তদাররা সেই সবজি দুজনকে ভাগ করে দিচ্ছেন।’
রাজধানীর উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. মেহেদী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারওয়ান বাজারে এখন মালের (সবজির) সংকট, বাড়তি দাম দিয়েও আমাদের পারাপারি করে মাল কিনে আনতে হচ্ছে।’
সরকারি সংস্থা টিসিবির গতকালের বাজারদরের তালিকায়ও সবজির দাম বাড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজধানীর বাজারগুলোয় গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে কাঁচা মরিচ কেজিতে ৪০ থেকে ৬০ টাকা বেড়ে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেগুন কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. সিরাজুল বলেন, এখন বগুড়া, যশোর, খুলনাসহ প্রায় সব জেলা থেকে সবজি কম আসছে। এক-দেড় মাস আগে থেকে চলছে দাবদাহ। নেই বৃষ্টি। এ কারণে সবজি উৎপাদনকারী বিভিন্ন জেলায় ফসল নষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে গেছে। উৎপাদন কম হওয়ায় কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। অন্য বছর এই সময় উত্তরবঙ্গ থেকে আসা সবজিতে কারওয়ান বাজার ভরে থাকত।
বাড্ডা কাঁচাবাজারে কথা হয় ক্রেতা সারোয়ার হোসেনের সঙ্গে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ সব পণ্যের দাম বাড়তি। এত দিন পেঁয়াজ ও সবজির দাম কিছুটা কম ছিল। এখন এসব পণ্যও লাগামহীন হয়ে পড়েছে। খুবই কষ্টে আছে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষ। পরিবারের খরচ ৪০ শতাংশ কমিয়েও সংসার চালাতে পারছি না। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।’
বগুড়ায় কৃষক ও পাইকারি পর্যায়ে সবজির দাম বাড়তি : বগুড়ায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে কৃষক পর্যায়ে ও পাইকারি বাজারে সবজির দাম অনেক বেড়েছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানান, জমিতে সবজি উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমেছে। এ কারণে সব সবজির দাম বেড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বগুড়ার মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা যায়, কৃষক তাঁদের উৎপাদিত করলা প্রতি মণ বিক্রি করছেন দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকায়। পটোল বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে, টমেটো ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা মণ, বেগুন প্রকারভেদে এক হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা মণ, ঢেঁড়স এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা মণ, শজনে চার হাজার টাকা মণ, কাঁচা মরিচ প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৮০০ টাকায়, পেঁপে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা মণ, মুলা ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা মণ, কচুর লতি এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা মণ, শসা প্রকারভেদে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা মণ, পাকরি জাতের আলু বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকা এবং কার্ডিনাল এক হাজার টাকা মণ।
মহাস্থান হাটে বেগুন বিক্রি করতে আসা শিবগঞ্জ উপজেলার অর্জুনপুর গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারোত দাম বেশি হলে কী হবি, ভিঁওত (জমিতে) তো ফলন নাই। ফলন বেশি হলে দাম এমনিতেই কমে আসলোহিনি।’
চক ভোলাখা গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল হক মোজা করলা বিক্রি করতে এসেছিলেন মহাস্থান হাটে। তিনি বলেন, ‘গরমে ভিঁওত তো গাছই টিকিচ্চে না, ফুল আসপি কী করে? আর ফুল না ধরলে তো ফলন হবিনে। সামান্য করে ফলন হচ্চে, তাই দাম বেশি।’
মহাস্থান হাটের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী মা সফুরা ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী শাহাদৎ হোসেন এবং বিশাল ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী পুটু মিয়া জানান, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে সবজির আমদানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। সবজি আমদানি কম হওয়ায় প্রতি হাটেই তুলনামূলক দাম বাড়ছে।
গতকাল বগুড়ার কাঁচাবাজার রাজাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, করলার পাল্লা বিক্রি হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়, পটোল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পাল্লা, মিষ্টিকুমড়া ১১০ থেকে ১২০ টাকা পাল্লা, টমেটো ১৬০ টাকা পাল্লা, বেগুন প্রকারভেদে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পাল্লা, ঢেঁড়স ২০০ টাকা পাল্লা, শজনে ৫০০ টাকা পাল্লা, কাঁচা মরিচ ৬০০ টাকা পাল্লা, পেঁপে ১৭৫ থেকে ২৫০ টাকা পাল্লা, মুলা ১৫০ টাকা পাল্লা, কচুর লতি ৩০০ টাকা পাল্লা, শসা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পাল্লা, পাকরি জাতের আলু ২৮০ টাকা এবং কার্ডিনাল আলু ২০০ টাকা পাল্লা দরে বিক্রি হয়েছে।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবুর রহমান খরার কারণে সবজির উৎপাদন ও আমদানি কম হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘বগুড়ায় চলতি মৌসুমে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। কৃষকরা এখন যে দাম পাচ্ছেন তা উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে।’
উৎপাদন পর্যায়ে কাঁচা মরিচ ও পেঁপের বাড়তি দাম : মানিকগঞ্জের বড় বাজারে মরিচের কেজি ১৬০ টাকা। আর মানভেদে পেঁপের কেজি ৮০ টাকা। অথচ মানিকগঞ্জের কয়েকটি উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে মরিচ ও পেঁপের চাষ করা হয়। কিন্তু খরা ও অসহনীয় গরমের কারণে এই মৌসুমে মরিচের উৎপাদন অর্ধেক হয়েছে। পেঁপের উৎপাদনও কম। পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় বাজারে এ দুটি পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। তবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, গত দুই দিন বৃষ্টি হওয়ায় কয়েক দিনের মধ্যে উৎপাদন বেড়ে কাঁচা মরিচ ও পেঁপের বাজার সহনীয় হয়ে যাবে।
মানিকগঞ্জে কাঁচা মরিচের সবচেয়ে বড় হাট বরঙ্গাইল হাট। শিবালয়, ঘিওর ও হরিরামপুর উপজেলায় উৎপাদিত মরিচ পাইকারি পর্যায়ে এই হাটে বিক্রি করা হয়। গতকাল বিকেলে ওই হাটে গিয়ে দেখা গেছে, পাইকারিতে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। ঘিওর উপজেলার সায়েদুর রহমান জানান, এবার খরার কারণে স্বাভাবিক উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। ফলে বাজারে কাঁচা মরিচের সংকট সৃষ্টি হয়ে দাম বেড়েছে।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছে কালের কণ্ঠ’র বগুড়া অফিস ও মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি)