মিয়ানমারে সংঘাতের জের ধরে নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। সরকারি হিসাবেই ৮০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করা হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে তা এর মধ্যে লাখ ছাড়িয়েছে। তবে এবার আগের মতো প্রকাশ্যে দল বেঁধে আসছে না বলে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে না। কিন্তু প্রতিদিনই সীমান্তের কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্যাতন ও নানা কৌশলে বাংলাদেশে অবৈধভাবে রোহিঙ্গা ঠেলে দিচ্ছে আরাকান আর্মি। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি স্বীকার করে সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমাদের নীতিগত অবস্থান ছিল আর কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেব না। তবে পরিস্থিতি কখনো কখনো এমন দাঁড়ায়- আমাদের কিছু আর করার থাকে না। রোহিঙ্গাদের আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ঢুকতে দিয়েছি- তাও না। তারা বিভিন্ন পথে ঢুকেছে। প্রচুর দুর্নীতি আছে সীমান্তে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থাৎ দালালদের টাকা দিয়ে তারা ঢুকছে। নৌকা নিয়ে ঢুকছে। শুধু একটা সীমান্ত দিয়ে যে তারা ঢুকছে, বিষয়টি এমনও নয়। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তারা ঢুকছে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নন-স্টেট অ্যাক্টরের (আরাকান আর্মি) সঙ্গে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দর-কষাকষি করতে পারে না। সম্প্রতি দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় পেয়েছেন মো. আরজ। তিনি বলেন, বাধ্য হয়ে দালালের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি।
নাফ নদ ও সীমান্তে বিজিবি এবং কোস্টগার্ড বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও দালালদের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সীমান্তের অধিবাসীরা জানান, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দুই দেশের দালালরা সহযোগিতা করছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এসব দালাল সুযোগ বুঝেই কাজ করে। আগে তারা আরাকান আর্মির কাছে নিত্যপণ্য পৌঁছে দিয়ে প্রচুর আয় করত। এখন তারা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা করে টাকা কামাচ্ছে। এ বিষয়ে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ২৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান জাফর বলেন, রাখাইনে যুদ্ধের নামে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হচ্ছে। এখনো মংডু শহরে ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। সেখানে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। নাফ নদ সীমান্তে হ্নীলার ফুলের ডেইল এলাকার আবদুর রশিদ বলেন, দালালরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে নৌকায় রোহিঙ্গাদের এপারে সীমানায় নিয়ে আসে। এরপর সুযোগমতো গন্তব্যে পাঠানো হয়। দালালরা আটক না হলে অনুপ্রবেশ ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ ও কঠিন হয়ে পড়বে। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মংডু সীমান্তে জড়ো হয়েছে আরও ৪০-৫০ হাজার রোহিঙ্গা।
সম্প্রতি কতজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে- এতদিন এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও ২৬ ডিসেম্বর শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের (আরআরআরসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- নতুন করে বাংলাদেশে ৬৪ হাজার ৭১৮ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৪৭৮টি এফডিএমএন (বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক) তথা রোহিঙ্গা পরিবার গত কয়েক মাসে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোয় প্রবেশ করে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৪৪ জন চাকমা ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের দুজন উখিয়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে সম্প্রতি মিসর সফরকালে মালয়েশিয়ার মিনিস্টার অব হায়ার এডুকেশন ড. জামব্রি আবদুল কাদিরের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন নতুন করে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, যে হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। কারণ অনেকে ক্যাম্পে অবস্থান না নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছে। বিত্তশালী রোহিঙ্গারা টেকনাফ ও উখিয়ায় বাসা ভাড়া করে বসবাস করছে বলেও জানা যায়।
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেকের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতে নানা কৌশলে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। বাংলাদেশে তারা উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশাপাশি যাদের বাংলাদেশে আত্মীয়স্বজন ও পূর্বপরিচিত লোক রয়েছে তাদের বাসায় উঠছে। এর মধ্যে যেসব রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফে এসেছে, তাদের এখনো বায়োমেট্রিক হয়নি। তাদের নিবন্ধন না করায় সঠিক হিসাবও মিলছে না। গত ২৪ ডিসেম্বর রোহিঙ্গাবিষয়ক ন্যাশনাল টাস্কফোর্সের (এনটিএফ) বৈঠক হয়েছে। নতুন করে যেসব রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, ওই বৈঠকে তাদের বায়োমেট্রিকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে অনুপ্রবেশকারীরা নিবন্ধনের আওতায় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ধারণা, জাতিসংঘের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হলে বাংলাদেশে সব ধরনের সাহায্য মিলবে। এ আশায় নতুন করে আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে আগ্রহী হবে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নাফ নদে কড়াকড়ি পাহারা থাকায় পাহাড়ি পথ দিয়ে আরও বেশি ঢুকছে রোহিঙ্গারা। মংডু শহর আরাকান আর্মির দখলে চলে যাওয়ার পরও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের হার বেড়েছে।
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।