সাইম হোসেন : রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে চারদিন ধরে গ্যাস সংযোগ নেই। গত ১০ মে থেকে তিতাস গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ওই এলাকার গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে। বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় এবং অবৈধ গ্যাস সংযোগ ঠেকাতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তিতাস। সংযোগ না থাকায় ওই এলাকার লক্ষাধিক মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে অভিযোগ করেছেন, তারা নিয়মিত বিল পরিশোধ করে আসলেও তাদের সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
তবে তিতাসের দাবি, ওই এলাকায় বৈধ গ্রাহক ১২ হাজার। অথচ সংযোগ ব্যবহার করছেন এক লাখেরও বেশি গ্রাহক। অর্থাৎ প্রায় ৯০ হাজার গ্রাহক অবৈধভাবে সংযোগ নিয়েছে। এছাড়া বৈধ গ্রাহকদের কাছেও বড় অংকের বিল বকেয়া রয়েছে। প্রায় ৬৬ কোটি টাকা বকেয়া বিল পড়ে আছে। এতে সরকারের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে গ্যাস সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে।
কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দারা বলছেন, গত চারদিন ধরে গ্যাস না থাকায় তারা লাকড়ি দিয়ে রান্না করছেন। এ কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হওয়ায় লাকড়ি ভিজে যাচ্ছে। এতে রান্না করে খেতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শুক্রবার (১৩ মে) দুপুরে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, গ্যাস না থাকায় নারী ও শিশুরা চরম বিপাকে পড়েছে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা হোটেল বা দোকানে গিয়ে খাবার খেলেও বাড়িতে নারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
ঝাউলাহাটির বাসিন্দা মো. মনির হোসেন দৈনিক সময়ের সংবাদ. কমকে বলেন, ‘চারদিন ধরে গ্যাস নেই। খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা বলে বোঝানো যাবে না। সকালে রুটি, দুপুরে পাউরুটি কিংবা মাঝে মাঝে অন্য কিছু খেয়ে দিন কাটছে। পরিবারে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছি। তাদের তো এটা-সেটা রান্না করে খাওয়াতে হয়। কিন্তু এখন সেটা পারছি না।’
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত মাসেও টাকা (গ্যাস বিল) দিয়ে আসলাম। অথচ এখন গ্যাস নেই। কবে গ্যাস পাবো, সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এলাকায় মাইকিং করে শুধু বলেছে, কয়েকদিন জরুরি কারণে গ্যাস বন্ধ থাকবে।’
কামরাঙ্গীরচরের ঝাউচরে নিজের বাসায় রান্নার দুর্ভোগের কথা জানালেন রওশন আক্তার বেবি। দৈনিক সময়ের সংবাদকে তিনি বলেন, ‘লাকড়ি দিয়ে পরিবারের ৮ সদস্যের প্রতিদিন দুই বেলা রান্না করা খুব কষ্টকর। আবার বাজারে লাকড়িও পাওয়া যাচ্ছে না। আগে এক মণ লাকড়ি ছিল ২০০ টাকা। এখন সেটি ২৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে লাকড়ি দিয়ে রান্না করলে অনেক ধোঁয়াও হয়।’
নুরজাহান বেগম নামের এক নারী ইটের চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। এসব লাকড়ি শুকনো না, অনেকগুলোই বৃষ্টির মধ্যে ভিজে গেছে। ভেজা লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এতে প্রচুর ধোঁয়া হচ্ছে।’
এদিকে, গ্যাস না থাকায় অনেকেই প্রেসার কুকার কিংবা সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা কিনেছেন।
গ্যাস না থাকায় বাবুর্চি এনে রান্না করেছেন বলে জানালেন মোহাম্মদ সেলিম নামের এক বাসিন্দা। বড় পরিবারের রান্নাবান্না নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে ১৭ জন সদস্য। গতকাল বাবুর্চি দিয়ে বাসার বাইরে রান্না করেছি। সেটা তিনবেলা খেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি রাইস কুকারের ব্যবসা করি। কয়েক বছরে যত রাইস কুকার বিক্রি করেছি, এ কয়েকদিনেই তার সমান রাইস কুকার বিক্রি করেছি। সমস্যায় পড়ে মানুষ এখন এগুলো কিনতে শুরু করেছে।’
অন্যদিকে, গ্যাস সংযোগ না থাকায় এলাকায় খাবারের দাম বেড়েছে বলেও জানিয়েছেন অনেকে। হোটেলগুলোতে পাঁচ টাকার পরোটা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। আবার যেখানে আগে ১০ টাকার ভাত পাওয়া যেতো, সেখানে এখন ২০ টাকার নিচে ভাত কেনা যাচ্ছে না।
অবৈধ গ্যাস সংযোগে প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কয়েকদিন পরই সংযোগ কারীদের মেনেজ করে আবার সংযোগ দেওয়া শুরু করেন প্রভাবশালীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা দৈনিক সময়ের সংবাদ. কমকে বলেন, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বেশি খুশি হন। সবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তারাই আবার প্রশাসনের সহযোগিতায় নতুন গ্যাস সংযোগ দিয়ে যান। আমরা এখানে কিছু বলতে গেলেই নানা সমস্যায় পড়ি। এমনকি হামলার শিকারও হতে পারি। তাই সেভাবে কেউ কিছু বলি না।
এলাকায় গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ জানেন না কামরাঙ্গীরচর এলাকার ৫৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূরে আলম চৌধুরী। অবৈধ গ্যাস সংযোগে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানালেন তিনি।
কাউন্সিলর নূরে আলম দৈনিক সময়ের সংবাদ. কম বলেন, এলাকায় কে বা কারা গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, আমি জানিনা। আমি নিজেও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছি। শিগগিরই আমি চেষ্টা করবো তিতাস গ্যাসের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে।
তবে বৈধ গ্যাস সংযোগকারীদের দুর্ভোগ ও সংকট দ্রুত সমাধানের কোনো পদক্ষেপ দেখছেন না স্থানীয়রা। তবে অবৈধ সংযোগ ও বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে জানিয়েছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ দৈনিক সময়ের সংবাদকে বলেন, ‘সেখানকার গ্রাহকরা অনেক বছর ধরে বিল দেন না। অনেক গ্রাহকের কাছে ৯ লাখ, ৮ লাখ, ৭ লাখ টাকার বিল বকেয়া। ১২ হাজার গ্রাহকের ৬৬কোটি টাকা বকেয়া সেখানে। বৈধ গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, তারা বিল দিলেও গ্যাস পান না। অবৈধ গ্রাহকদের জন্য তাদের গ্যাস পেতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।। আবাসিক থেকে শুরু করে চানাচুর, আইসক্রিম তৈরির প্রতিষ্ঠানও অবৈধ সংযোগ নিচ্ছে। বৈধ গ্রাহক ১২ হাজার হলেও সেখানে এক লাখ অবৈধ গ্রাহক রয়েছেন।’
অবৈধ সংযোগ দেওয়া প্রভাবশালীদের সঙ্গে তিতাসের লোকজনও সম্পৃক্ত রয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ কথার সত্যতা নেই। তাহলে যারা বৈধ গ্রাহক, তারা অবৈধদের পাহার দিক। তাদের লাইন থেকে যেন অবৈধ সংযোগ কেউ নিতে না পারে। আমরা তো আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাহার দিতে পারবো না।’
হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে তারা যে গ্যাস নিচ্ছে, তাতে তো সরকারি সম্পত্তি অপচয় হচ্ছে। ঢাকা শহরে লাখ লাখ অবৈধ সংযোগধারী রয়েছেন। আমরা শতচেষ্টায়ও এটা বন্ধ করতে পারছি না। এখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যারা বৈধ গ্রাহক, তারাই অবৈধদের নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করুক।’
কামরাঙ্গীরচরে পুনরায় সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তারা যদি অবৈধ সংযোগ না দেয় এবং বকেয়া পরিশোধ করে তাহলে আমরা সংযোগ ফিরিয়ে দেবো। আমাদের এখানে অনেক বকেয়া রয়েছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। বৈধ গ্রাহকদের কাছে বকেয়া ৬৬ কোটি। অবৈধ সংযোগ নেওয়ারা এরকম ৬৬কোটি টাকার গ্যাস ব্যবহার করেছে। যারা এখন অভিযোগ করে বেড়াচ্ছেন, তারা বেশিরভাগই অবৈধ সংযোগ ব্যবহারকারী। মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, এভাবে আর চলতে পারে না। আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি।