আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির প্রথম ভাষা সৈনিক। তার নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এবং তিনি প্রথম ভাষা সৈনিক হিসেবে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
বুধবার মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্ঠামণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু।
হানিফ বলেন, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছিল ভাষা আন্দোলনের জন্য অনন্য, অবিস্মরণীয় দিন। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এদিন প্রথম হরতাল পালিত হয়। এটি ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। সেই হরতালে নেতৃত্ব দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুলিশি নিযাতনের শিকার হন এবং গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে এটিই ছিল কোনো রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতারের প্রথম ঘটনা। এটি ছিল প্রথম কোনো ভাষা সৈনিকের গ্রেফতারের ঘটনা।
হানিফ আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল। নতুন দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো। একটা ভারত আরেকটি পাকিস্তান। পাকিস্তানের দু’টি ভূখন্ড। একটি পশ্চিম পাকিস্তান ১২০০ মাইলে দূরে পূর্ব পাকিস্তান। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অমিল থাকার পরও দুইটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা; অন্যদিকে, মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ কথা বলত উর্দুতে। সেই উর্দুকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা শুরু করে। আমাদের ৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যুব যুবলীগ। এই সম্মেলনে ভাষা বিষয়ে কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব পাঠ করেন তরুণ ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সম্মেলনে প্রস্তাব করিতেছি যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার ভাষা ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক।
তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করা হয়। পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বক্তক্য দেন এবং তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষার উর্দু হোক। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবকে বিবাদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লাখ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সংসদ সদস্যের সমর্থন করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে। অনেক বিতর্কের পর প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। সংসদ দলের আপত্তির কারণে অনেক বাঙালি মুসলমানও সংশোধনীটিকে সমর্থন করতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের এ সিনিয়র নেতা বলেন, ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং আন্দোলনে ফেটে পড়ে। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনসংলগ্ন আমতলায় ছাত্রসভা হয়। নুরুল আমীন সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি। ছাত্রসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১০ জন মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙবে। ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙলো। সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী গুলি ছুড়লে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু তখন কারারুদ্ধ। কারাগারেই তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করে অনশন করেন।
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি আরও লিখেছেন, ‘মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ জন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালিরা করতে চায়নি। তারা চেয়েছে বাংলার সঙ্গে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু বাঙালির এ উদারতাটাই অনেকে দুর্বলতা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।’ ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন দেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামে গ্রামে মিছিল হতো। সেই মিছিলে স্কুলের ছাত্রদের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। স্লোগান, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হউক,’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘আমার ভাষা তোমার ভাষা, বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা’।
তিনি বলেন, বায়ান্নর ভাষা শহীদদের পবিত্র রক্তের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের গৌরবগাঁথা। ছাত্র সমাজের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করেছিল। গৌরবময় আসনে আসীন। বিশ্বের প্রতিটি মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দিগন্ত উন্মোচন করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। এ দেশের মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র। বাঙালিকে করেছে মহীয়ান। মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে মহান স্বাধীনতার চেতনা। ১১ মার্চ এর পথ ধরে ’৫২, ’৬৯ এবং ’৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জানতেন! কারণ তিনি দূরদর্শী নেতা ছিলেন, লক্ষ্য স্থির করে কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন। যেদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেদিনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এ পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি; একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। আর তাই তিনি ধাপে ধাপে সমগ্র জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য।
হানিফ বলেন, একদিন মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির পিতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; আজ তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মপরিচয়ের দিন হিসেবে চিহ্নিত। একুশে ফেব্রুয়ারি, ‘৬৯, ‘৭১ এর পথ ধরে আমাদের স্বাধীনতা এসেছিল জাতির পিতার নেতৃত্বে। আজ তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এই দেশ যতদিন শেখ হাসিনার হাতে থাকবে দেশ তত দ্রুত উন্নয়ন-অগ্রগতিতে এগিয়ে যাবে। গোটা বিশ্বের কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সকল সীমাবদ্ধতাকে মোকাবেলা করে শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তির মধ্যেও বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত। বাংলাদেশ আজ গোটা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত।
এসময় ১৪ দলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে হানিফ বলেন, এখন পর্যন্ত এই বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সামনের কঠিন দিনের জন্য সকল ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।