ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাকশিল্প শ্রমিকদের আন্দোলনের গতি দিন দিন বাড়ছে। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবারই শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। অতীতে ২০০৬-২০০৭ সালে, ২০১৩ সালে এবং ২০১৭ সালে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিল। বিশেষত: মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে এ আন্দোলন হলেও এ কাজটিতে নানা মহলের ইন্ধন দেখছেন কেউ কেউ। যেসব কারখানায় শ্রমিকদের মজুরি এবং কর্মপরিবেশ ভালো সেগুলোতে অসন্তোষ দেখা দেওয়ায় এ খাতের মালিকরা শঙ্কিত।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের প্রধান এবং এডিশনাল আইজিপি মাহবুবুর রহমান ইত্তেফাককে বলেছেন, তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে পোশাকশিল্প খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর পেছনে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, শ্রমকিদের আন্দোলন মূলত :মজুরি বোর্ডকে ঘিরে। এ বোর্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়ায় নির্বাচনের আগে আগে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। যে কারণে নির্বাচনের আগে আগে কারখানাগুলোতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তিনি জানান, মজুরি বোর্ডের মেয়াদ পাঁচ বছরের অধিক কিংবা তার কম করা যায় কিনা সে বিষয়ে আমরা সরকারকে অনুরোধ করব। আশা করছি, এতে নির্বাচনি বছরে এ খাতে সহিংস আন্দোলন কমবে।
তবে, মাহবুবুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন শিল্প মালিকরা। মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি এ বি এম সামছুদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, ২০০৬ সালে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে মজুরি বোর্ড ছিল না। তখনো আন্দোলন হয়েছে। এ সংকটের পেছনে অন্য কারো ইন্ধন থাকতে পারে। এছাড়া নির্বাচনের আগে মজুরি বৃদ্ধি করে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর একটি কৌশলও থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার দাবিতে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে ব্যাপক শ্রমিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিনই নতুন নতুন জায়গায় সহিংসতা চলতে থাকে। বেশ কয়েকটি ভালো ভালো কারখানাও তখন আক্রান্ত হয়। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আবারও পোশাকশিল্প খাতে অসন্তোষ শুরু হয়। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া এ অসন্তোষ ২০১৪ সাল পর্যন্ত চলে। তখন তার সাথে যুক্ত হয় ৯৬ দিনের হরতাল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও তৈরি পোশাকশিল্প খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। সবশেষ গত কয়েক দিনের তৈরি পোশাক শিল্পের অস্থিরতা অতীতের ঘটনাগুলোকেই মনে করিয়ে দেয়।
তৈরি পোশাকশিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের শিল্পগুলো এমনিতেই ধুঁকছে। অনেক কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় চলমান অস্থিরতা এ খাতকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলবে।
পোশাক শিল্প খাতের বড় উদ্যোক্তা এবং বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি এ বি এম সামছুদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, যেসব দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড টেক্সটাইল খাতকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল সেসব দেশে এ খাতটি ৩০ বছরের বেশি টেকেনি। তবে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে এখানে এ খাতটি এখনো টিকে আছে। যে কোনো দাবি আদায়ে শ্রমিকরা আন্দোলন করতেই পারে। কিন্তু এসব দাবি আদায়ে আগে আল্টিমেটাম দিতে হয়। কোনো আন্দোলনের আগে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বিজিএমইএ বা কারখানা কর্তৃপক্ষকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়নি। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য তাদের মজুরি বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। কিন্তু এ লক্ষ্যে আগে আল্টিমেটাম দেওয়াসহ আলোচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারেরও ভূমিকা আছে। এসব অস্থিরতার গোড়ায় গিয়ে সরকারকেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রতিযোগী দেশ যেমন, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে এ ধরনের আন্দোলন হয় না। সেখানে এ ধরনের ইস্যু উঠার আগেই সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করে। তার মতে, এ ধরনের সহিংসতা চলতে থাকলে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। কারণ ক্রেতাদের এখন কোনো কারখানা মালিকের কাছ থেকে তথ্য নিতে হয় না। অ্যাকর্ড অ্যান্ড অ্যালায়েন্স বাংলাদেশে তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করছে।
এদিকে, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের নামে কোনো কারখানা ভাঙচুর হলে সংশ্লিষ্ট কারখানা বন্ধ করে দিতে বলেছে বিজিএমইএ। গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান এ নির্দেশ দেন। তবে পোশাকশিল্প মালিকদের কেউ কেউ সভাপতির এ ঘোষণার সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, কারাখানা বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়। বরং কারখানা চালু রেখে শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
উল্লেখ্য, ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২৩ হাজার টাকা, মজুরির ৬৫ শতাংশ মূল বেতন ও বছরে ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট এর দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে পোশাকশ্রমিকরা। মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা মজুরি বোর্ডের বৈঠকে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা করা প্রস্তাব দেন। এছাড়া সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকার প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পান মাত্র ৮ হাজার টাকা।
