মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত ১১টি নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন সেবার মূল্য এক বছরের ব্যবধানে সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ডিম, মাংস, সবজি, ভোজ্যতেল, বিবিধ খাদ্যপণ্য, কোমল পানীয়, কাপড় ও জুতা এবং বাসা ভাড়া ও জ্বালানি।
এছাড়াও গৃহসামগ্রী, গণপরিবহণ, বিনোদন ও শিক্ষা এবং বিবিধ পণ্য ও সেবাও আছে এ তালিকায়। এসব পণ্য ও সেবার দাম হুহু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু দেশীয় ও বৈশ্বিক বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মানুষের আয় বাড়েনি। তাই জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করে জীবিকানির্বাহ করছে মানুষ।
বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্য-আয়ের মানুষের অবস্থা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’র মতো। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দামের কারণে মূল্যস্ফীতিতে প্রবল চাপ পড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
তবে এ গবেষণায় মাত্র ৪টি পণ্য-সেবার দাম বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নিচে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ ৪টি পণ্যসেবার তথ্য নিয়ে অনেকেই আপত্তি করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই গবেষণায় দেখা যায়, গত এক বছরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত প্রায় সব পণ্য ও সেবার দামই বেড়েছে। দাম কমেনি কোনো পণ্য ও সেবার। এর মধ্যে ১১টি নিত্যপণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ। কিছু পণ্যের দাম ৭ শতাংশের কম বেড়েছে। যেগুলোর দাম ৭ শতাংশের নিচে দেখানো হয়েছে; সে তথ্য নিয়ে অনেকের আপত্তি রয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের সঠিকতা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই আপত্তি তুলেছেন। সরকারের একাধিক মন্ত্রীও তাদের তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গত জুনে তারা মূল্যস্ফীতির হার দেখিয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
কিন্তু বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এক গবেষণায় দেখিয়েছে ওই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার কমপক্ষে ১২ শতাংশ। তাদের এই তথ্যের সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরাও একমত প্রকাশ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, বাজারে পণ্যমূল্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, সে হারে মূল্যস্ফীতিতে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তার মানে হচ্ছে সরকার কিছু একটা আড়াল করছে। তথ্যের সঠিকতা না থাকলে বাস্তবতা অনুধাবন করা যাবে না। সঠিক তথ্য প্রকাশ করে সংকট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিলে সবাই কমবেশি প্রস্তুতি নিতে পারবে। এই সংকট সরকার শুধু এককভাবে মোকাবিলা করতে পারবে না। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মোকাবিলা করতে হবে। ফলে সংকট কী, কতদিন থাকতে পারে, কোন খাতে জনগণকে কী ছাড় দিতে হবে-এসব বিষয়ে জানানো দরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে, গত বছরের জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুনে চালের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। আগের বছর এর দাম বেড়েছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে চালের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ডিম ও মাংসের দাম ২০২০ সালের জুনের তুলনায় গত বছরের জুনে বেড়েছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ বছরের জুনে বেড়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
বিশেষ করে গরিবের প্রোটিন বলে পরিচিত ডিমের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। মাংসের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এই দুটি মিলে এক বছরে দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, সবজির দাম গত বছরের জুনে কিছুটা সহনীয় ছিল। ২০২০ সালের জুনের তুলনায় গত বছরের জুনে তেমন বাড়েনি। ওই সময়ে এর দাম বেড়েছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু গত বছরের জুনের তুলনায় এ বছরের জুনে সবজির দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে এ বৃদ্ধি ২৬ গুণ। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
গত বছরের জুনে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছিল ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জুনে বেড়েছে ৩১ দশমিক ১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
বিবিধ খাদ্যপণ্যের দাম গত বছরের জুনে বেড়েছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। গত জুনে তা বেড়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। এক বছরের তুলনায় এর দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। কোমল পানীয় পণ্যের দাম গত বছরের জুনে বেড়েছিল ৮০ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছরের জুনে তার ওপর আরও বেড়েছে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। এই খাতে দাম বাড়ার হার গত বছরের তুলনায় বেশ খানিকটা কমেছে। তবে পণ্যটি অত্যাবশ্যকীয় নয়।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত বছরের জুনে কাপড় ও জুতার দাম বেড়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। গত জুনে তা বেড়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। গৃহসামগ্রীর পণ্য কেনার দাম গত বছরের ওই সময়ে বেড়েছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এ বছরের জুনে তা বেড়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। গত বছরের জুনে গণপরিবহণ ব্যয় বেড়েছিল ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ বছরের একই মাসে বেড়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিনোদন ও শিক্ষা খাতে গত বছরের জুনে ব্যয় বেড়েছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এ বছরের ওই মাসে বেড়েছে ৭ শতাংশ। বিবিধ পণ্য ও সেবা খাতে গত বছরের জুনে বেড়েছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এ বছরের জুনে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার বড় অংশই প্রভাবিত করছে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতাকে। এছাড়া সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়া, চাহিদার সঙ্গে পণ্যের অমিল, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে অস্থিরতা, ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মূল্যস্ফীতির হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেশি দামে পণ্য আমদানির কারণেও দেশের মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। আমদানিজনিত খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশের বেশি। কেননা অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার বড় অংশই আসছে আমদানির মাধ্যমে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিই মূল্যস্ফীতিতে বড় চাপ ফেলছে।
প্রতিবেদনে ডালের মূল্যস্ফীতির হার সম্পর্কে বলা হয়, গত বছরের জুনে এর দাম বেড়েছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ। এ বছরের জুনে বেড়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। মাছের দাম সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত বছরের জুনে বেড়েছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ বছরের জুনে তা বেড়েছে ২ দশমিক ১ শতাংশ। চিকিৎসা ব্যয় গত বছরের জুনে বেড়েছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। গত জুনে বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ তথ্যের সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। মাছের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত বছরের জুনে যে রুইমাছ ছিল ২৫০ টাকা কেজি। সেগুলো এখন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি। অন্যান্য মাছের দামও বেশ চড়া। ডালের দামও আগের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। গত বছরের জুনে যে মসুর ডালের কেজি ছিল ১১০ টাকা। এখন সেগুলো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। চিকিৎসা ব্যয়ও বেশি বেড়েছে। কেননা আলোচ্য সময়ে সব ধরনের ওষুধ দাম ও চিকিৎসা উপকরণের দাম বেশি মাত্রায় বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আগামী দিনে এ হার আরও বাড়তে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরো অঞ্চলের মতো অর্থনীতিও মূল্যস্ফীতির চড়া আঘাতে আক্রান্ত। প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ও স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে কম মূল্যে খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আমদানির বিকল্প পণ্য উৎপাদন ও কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।