পুলিশের বিদায়ী আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, দেশে এক ধরনের নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট চর্চা ছিল, এখনো আছে। এক শ্রেণির মানুষ অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে আমাকে তাদের বিপক্ষে আবিষ্কার করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তাদের প্রতিও আমার কোনো অভিযোগ নাই, কোনো অনুযোগ নাই। তারাও ভালো থাকবেন সে প্রত্যাশা করবো। কারণ সবাইকে নিয়েই আমাদের আজকের বাংলাদেশ। গতকাল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৩৪ বছরের কর্মজীবন শেষে অবসরে যাওয়ার আগে শেষ কর্মদিবসে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের নানা অর্জনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
বেনজীর বলেন, আমার ৩৪ বছর ৫ মাস ১৬ দিন কর্মজীবনের মধ্যে ২০১০ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১২ বছর পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে দায়িত্ব পালন করেছি। ডিএমপি কমিশনার, র্যাব ডিজি ও সর্বশেষ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপনারা সমর্থন যুগিয়েছেন, দেশবাসীও সমর্থন যুগিয়েছেন। তাই সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। দায়িত্ব পালনকালে সব ভালো কাজের কৃতিত্ব সরকার ও জনগণের।
আর ব্যর্থতাগুলো আমি নিচ্ছি। ব্যর্থতার দায় নেয়ার সৎ সাহস আমার আছে।
দায়িত্ব পালনকালে চেষ্টা করেছি মানুষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। চাকরির শেষদিন মানে আজ থেকে জীবনের একটি পাতা উল্টিয়ে নতুন পাতা পড়ার চেষ্টা। তার মানে আজ থেকে দেখা হবে না-কথা হবে না এমনটি নয়। সামাজিক জীব হিসেবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। যেখানেই সুযোগ পাবো একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করবো। বলেন, পোশাকে এটাই সর্বশেষ প্রেস ব্রিফিং আমার। বর্তমান পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি গণমুখী। আমাকে আপনারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, একইভাবে পরবর্তী দায়িত্বে যারা আসবেন তাদেরও সহযোগিতা করবেন।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ পুলিশের দুটি বিষয় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, কীভাবে আমরা সফলভাবে করোনা ক্রাইসিস অতিক্রম করেছি এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের সাফল্যের বিষয়ে সবাই জানতে চায়। কিছুদিন আগে জাতিসংঘে কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্ট আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে, আমরা কীভাবে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সফল হয়েছি।
চাকরি জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে বেনজীর আহমেদ বলেন, সব চ্যালেঞ্জই চ্যালেঞ্জ। যতক্ষণ না পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম না করতে পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত সেটাই নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ। তবে, ফরমালিনমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করা ও সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে। কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরাম নিহতের ঘটনায় অনুসূচনাবোধ কাজ করে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, যে পর্যন্ত বিষয়টি অন্যায্য বা অনৈতিক প্রমাণিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে আমার অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ নেই।
অবসরে গিয়ে রাজনীতি করবেন কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবসরে গিয়ে অবসর নিয়েই ভাববো। এতদিন সরকারের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করেছি। অবসরে ব্যক্তি হিসেবে মানুষের সেবা করার চেষ্টা করবো। এক কথায়, সমাজের অংশ হিসেবেই থাকবো। বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে অনেক সময় মানুষ মারা যায়, এ বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। আমাদের প্রাথমিক ও প্রধান লক্ষ্য থাকে মানুষের জীবন বাঁচানো। এর জন্যই আমাদের হাতে অস্ত্র থাকে। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে বিভাগীয় তদন্ত হয়ে থাকে।
অবসরেও নিরাপত্তা পাবেন: বেনজীর আহমেদ অবসরোত্তর ছুটিতে থাকাকালীন তার নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসহ পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে। গত বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শফিকুল ইসলামের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি পুলিশের আইজিপি বরাবর পাঠানো হয়েছে। এর একটি অনুলিপি পেয়েছেন বেনজীর আহমেদ। চিঠিতে বলা হয়েছে, অবসর প্রস্তুতিজনিত ছুটিকালীন তার নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে গাড়িসহ ১/৬ ফর্মেশনে সাদা পোশাকে এসকর্ট, অস্ত্রসহ ইউনিফর্মধারী দুজন সার্বক্ষণিক দেহরক্ষী এবং ১/৩ ফর্মেশনে হাউজগার্ড সার্বক্ষণিকভাবে মোতায়েনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এরআগে গত ২২শে সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে তার অবসরের বিষয়টি জানানো হয়। বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ই এপ্রিল আইজিপি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ শাখা থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৩০শে সেপ্টেম্বর বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৫৭ নং আইন) এর ধারা ৪৩ (১) (ক) অনুযায়ী সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করা হলো। একই প্রজ্ঞাপনে এক বছরের জন্য তার অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) মঞ্জুর করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়া বেনজীর আহমেদ আইজিপি হন ২০২০ সালের ১৫ই এপ্রিল। তার আগে প্রায় সাড়ে চার বছর এলিট ফোর্স র্যাবের নেতৃত্ব দেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ডিএমপি কমিশনার হিসেবেও। তবে, ‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র গত ডিসেম্বরে র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে ওই তালিকায় বেনজীর আহমেদের নামও আসে। যদিও বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।