রাজধানীর চকবাজারে একটি প্লাস্টিক কারখানায় ও গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের সবাই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়া বরিশাল হোটেলের কর্মী ছিলেন। ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের শরীর এমনভাবে পুড়েছে যে, তাদের চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। পাঁচ মরদেহের হাড় বেরিয়ে গেছে। ডিএনএ পরীক্ষা করা ছাড়া তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
তাই ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে চকবাজারের কামালবাগে এ ঘটনা ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের প্রায় ২ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
চতুর্থ তলা ভবনটির নিচতলার সামনের দিকে ছিল হোটেল (বরিশাল হোটেল)। পেছনের দিকে ছিল প্লাস্টিকের গোডাউন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ছিল পলিথিন ও জুতার সোলের গোডাউন। আর ভবনের চতুর্থ তলায় ছিল প্লাস্টিকের খেলনা ও খেলনা তৈরির সরঞ্জামের গোডাউন এবং কারখানা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিচতলার ‘বরিশাল হোটেল’ থেকে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত। এরপর আগুন ওপরের ফ্লোরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মতো সব ধরনের সরঞ্জামাদিতে ভরপুর ছিল ভবনটি। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। এ ঘটনা তদন্তে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
উদ্ধার কাজে নিয়োজিত কয়েকজন ফায়ার সার্ভিস কর্মী জানান, ভবনের দ্বিতীয় তলায় ভেতর থেকে দরজা আটকানো একটি কক্ষে ছয়জনের মরদেহ পাওয়া যায়। মরদেহগুলো আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। কার লাশ কোনটি তা চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পরে ভবনের একটি কক্ষে ছয়টি মরদেহ পাওয়া গেছে। সবার মরদেহ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মরদেহের মধ্যে চার জনের নাম জানা গেছে। তারা হলো- বিল্লাল (৩৫), ওসমান (২৫), মোঃ শরীফ (১৬), স্বপন সরকার (১৯), মোতালেব (১৬) ও রুবেল (২৮)।
মৃত বিল্লাল বরিশাল হোটেলের মেসিয়ার ছিলেন। তার বাবার নাম আলম সরদার। থাকতেন ভবনটির দ্বিতীয় তলায়। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদি। তার স্ত্রী তানিয়া আক্তার গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
বিল্লালের শ্যালক আব্বাস আলী বলেন, তার দুলাভাই বিল্লাল বরিশাল হোটেলের মেসিয়ার ছিলেন। নাইট ডিউটি করে ভবনের দ্বিতীয় তলায় ঘুমাচ্ছিলেন। আগুন লাগার পর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বিকেলের দিকে ফায়ার সার্ভিস তার লাশ উদ্ধার করে।
মৃত ওসমান বরিশাল হোটেলের রুটির কারিগর ছিলেন। তার বাবার নাম আবুল কালাম সরদার। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে। ওসমানের খালাত ভাই মোঃ রুবেল জানান, আমার খালাত ভাই যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সেটির নিচতলায় থাকা বরিশাল হোটেলে চাকরি করত। রাতে কাজ করে সে ভবনটির দুই তলায় ঘুমিয়েছিল। কিন্তু আগুন লাগার পরে তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
একাধিকবার তার ফোনে কল করলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। আমরা আগুন লাগা ভবনটির দুই তলায় গিয়েছিলাম। সেখানে মানুষের হাড়ের মতো কিছু দেখতে পেয়েছি। ফায়ার সার্ভিস যে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে, তার মধ্যে আমার খালাত ভাইয়ের লাশও রয়েছে।
মোঃ শরীফের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায়। বাবার নাম মিজান। তার মামা আরিফ এসে লাশ শনাক্ত করেন। স্বপন সরকারের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই। বাবার নাম রাকেশ সরকার। তার বড়ভাই সজল সরকার স্বপনের লাশ শনাক্ত করেন। মৃত মোতালেবের গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলায়। বাবার নাম মোস্তফা।
তার মামা নিজাম দপ্তরী লাশ শনাক্ত করেন। মৃত রুবেলের লাশ শনাক্ত করেন বড়ভাই মোহাম্মদ আলী হিলালু। রুবেলের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর। বাবার নাম সাত্তার হিলালু। এরা সবাই বরিশাল হোটেলের কর্মচারী ছিলেন। থাকতেন ভবনটির দ্বিতীয় তলায়।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা সদরের জোন-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক মোঃ বজলুর রশিদ বলেন, মৃত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের শরীর এমনভাবে পুড়েছে যে, তাদের চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। আরেকজনের চেহারা দেখলে কিছুটা বুঝা যায়। ছয়জনের মধ্যে অপর দুজনের পরিচয় এখনও (রাত ৮টা পর্যন্ত) নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, অগ্নিকা-ের শুরুর দিকে তারা মারা গেছেন। মরদেহগুলো দেখে প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। মরদেহগুলো মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ভবনের ভেতরে আমাদের সার্চ অভিযান চলছে।
আগুনে পুড়ে মরদেহগুলো অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির লালবাগ বিভাগের ডিসি মোঃ জাফর হোসেন।
চুড়িহাট্টার কায়দায় আগুনের সূত্রপাত ॥ আগুনটির সূত্রপাত ভবনটির নিচতলার বরিশাল হোটেলের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে হয়েছে বলে দাবি করেছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। এছাড়া সেখানে কাজ করতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিস কর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনেকেও বলছেন, ওই হোটেল থেকেই আগুনের সূত্রপাত। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন শুরুতে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারে যায়। সেখানে আরেক দফা বিস্ফোরণের পর প্লাস্টিকের খেলনা তৈরির কারখানায় আগুন লাগে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একই কায়দায় চুড়িহাট্টায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে।
কেমিক্যাল গোডাউন থেকে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারে, এরপর সেখান থেকে ভবনটির অন্যান্য ফ্লোরে থাকা গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। সোমবার প্লাস্টিকের গোডাউনের অগ্নিকা-ের সূত্রপাতও একইভাবে। ভবনটির নিচতলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত পলিথিন, প্লাস্টিকের খেলনা, জুতার সোলসহ বিভিন্ন খেলনা তৈরির সরঞ্জামে ভরপুর ছিল, যা আগুনকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, যেই ভবনটিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে, সেটি ঘিঞ্জি এলাকায়। প্লাস্টিকের বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকায় ভবনটি আগ থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ভবনটির চারপাশে ইটের দেয়াল, ওপরে টিনশেড। দেয়ালে সিমেন্টের প্রলেপ দেয়ার আগেই গড়ে তোলা হয় হোটেলসহ বিভিন্ন কারখানা ও গোডাউন। ওই ভবনে আবাসিক বসবাস না থাকলেও আশপাশের ভবনগুলো ছিল আবাসিক।
আগুন আতঙ্কে পাশের ভবনের বাসিন্দারা রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। কেউ কেউ ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। আশপাশের ভবনের ছাদেও আগুনের তাপের কারণে টিকতে পারছিলেন না বাসিন্দারা। পরে তারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। বাতাসের কারণে আগুন একেক বার একেক দিকে মোড় নেয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ভবনটির কাছে এগোতেই পারছিলেন না। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয় তাদের।
এদিকে নিখোঁজদের স্বজনরা ভবনটির সামনে আসেন স্বজনদের খোঁজে। তারা নাম ধরে ডাকতে থাকেন, খোঁজতে থাকেন স্বজনদের। কেউ কেউ আগুনের ভেতর দিয়েই ভবনে ঢোকার চেষ্টা করেন। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মী, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেন। তাদের সঙ্গে উৎসুক জনতার কারণে পুরো এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়।
ভবনটিতে জুতার সোল, পলিথিনসহ প্লাস্টিকের বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকায় এলাকাজুড়ে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। আশপাশের বেশির ভাগ ভবনগুলোও টিনশেডের হওয়ায় আগুনে সেসব সরঞ্জামাদি পুড়ে টিনের ওপরে পড়ছিল আর শব্দ হচ্ছিল। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে পাশের ভবনের ছাদে টাঙ্গানো পতাকাগুলোর পত পত করে ওড়া বন্ধ হয়ে যায়। কালো ধোঁয়ায় পতাকাগুলো লোহার মতো শক্ত হয়ে নিস্তেজ ও দ-ায়মান হয়ে যায়। যেন পতাকাগুলোর স্বাধীনভাবে উড়ার স্বাধীনতা কেউ নিজ হাতে হরণ করল!
দুপুর আড়াইটার দিকে ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস এ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, আগুন লাগা কারখানার ভবনসহ আশপাশের সব ভবনই ঝুঁঁকিপূর্ণ ছিল। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে এসে দেখি আশপাশের অনেক ভবনেই যত্রতত্র এ রকম বিভিন্ন ধরনের কারখানা গড়ে উঠেছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে ঘিঞ্জি এলাকা, অন্যদিকে এসব কারখানায় যখন-তখন যে কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
পাশাপাশি অনেক ভবনে মানুষ বাসও করছেন। তাদের জন্যই ঝুঁঁকি তৈরি হতে পারে। তবে আগুন লাগা ভবনের কোন কেমিক্যাল পাওয়া যায়নি। আমরা এখন প্লাস্টিকের খেলনা, জুতার সোল, পলিথিন থাকতে দেখেছি। আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোঃ জাফর হোসেন বলেন, ঘটনা প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনাই মনে হচ্ছে। আমরা এটাকে নাশকতা মনে করছি না। আগুনের ঘটনায় যদি কোন পক্ষের গাফিলতি থাকে তা সঠিকভাবে তদন্ত করে বের করার জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে একটি সাধারণ ডায়েরি করে রাখছি। যদি কারও গাফিলতি থাকে তাহলে আমরা আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি লালবাগ বলেন, অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। পুরান ঢাকায় অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে এর আগেও অনেক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সব সংস্থার সমন্বয় করে পুরান ঢাকাকে নিরাপদ করতে যা যা করার দরকার সে ধরনের উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করব।
তবে আগুনে ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনার পরও রাত পর্যন্ত ভবনটির মালিকের কোন হদিস পাওয়া যায়নি।