‘গতকাল সকালেও এই সড়ক শুকনা ছিল। আজ এখানে হাঁটুর ওপরে পানি। পানি দ্রুত বেড়েই চলছে। এভাবে বাড়তে থাকলে তো সিলেটের কোনো জায়গাই শুকনা থাকবে না’ বলছিলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ঝালোপাড়া এলাকার প্রবীণ তবারক হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এত দ্রুত পানি বাড়তে আগে কখনো দেখিনি। একদিনেই পুরো এলাকা তলিয়ে গেল।’
কেবল ঝালোপাড়াই নয়, পুরো সিলেটেই দ্রুত বাড়ছে পানি। জেলার বেশির ভাগ এলাকাই ইতোমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে শুক্রবার থেকে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী।
গত বুধবার থেকে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অথচ বৃহস্পতিবারই তা ভয়াবহ রূপ নেয়। এদিন বিকেল থেকে দ্রুত বাড়তে শুরু করে পানি। সিলেট নগরের বেশির ভাগ এলাকাই তলিয়ে গেছে এতে।
গত মে মাসের মাঝামাঝিতে আরেক দফা বন্যা হয় সিলেটে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে, মে মাসের বন্যায় গত ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানি হয় সিলেটে। তবে চলমান বন্যা গত মাসের রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি প্লাবিত এলাকার মানুষদের।
নগরের উপশহর এলাকার কয়সর আহমদ বলেন, ‘গত মাসের বন্যায় এতো পানি হয়নি। মে মাসের বন্যায় উপ শহরের মোড়ে পানি উঠেনি। এবার উপশহরের মোড়ও তলিয়ে গেছে। আর এবার পানি বাড়ছে দ্রুত। একদিনেই পুরো এলাকা তলিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আবার বাসার ভেতরে এখন কোমর সমান পানি। বাসার চৌকিও পানিতে তলিয়ে গেছে।’
বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে জেলার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। এই দুই উপজেলার প্রায় পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে এই দুই উপজেলার প্রায় সবগুলো সড়ক। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কও পানির নিচে। ফলে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সিলেটের সীমান্তবর্তী এ উপজেলা।
বাহনের অভাবে প্লাবিত এলাকার মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেও আসতে পারছে না। তাদের উদ্ধারে শুক্রবার থেকে নেমেছে সেনাবাহিনী। এই দুই উপজেলায় বন্যার্তদের সহযোগিতায় সেনাবাহিনী কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান।
কোম্পানীগঞ্জের বর্ণী এলাকার আব্দুর রশিদ বলেন, ‘২০০৪ সালের বন্যার সময়ও সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কে পানি উঠেনি। এবার একদিনেই তলিয়ে গেছে সড়ক। পানি যেভাবে দ্রুত বাড়ছে তাতে এবারের বন্যা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে।’
কোম্পানীগঞ্জ-গোয়ানঘাট ছাড়াও জেলার সদর, দক্ষিণ সুরমা, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, বিশ্বনাথ উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এছাড়া সিলেট নগরের অন্তত ৩০ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক উপচে পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সুরমা, কুশিয়ারাসহ সিলেটের সবগুলো নদ-নদীর পানি সবগুলো পয়েন্টেই বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে পানি ক্রমশ বেড়েই চলছে।
এদিকে, প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটর উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে। এই দুই রাজ্যে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। শুক্রবার থেকে পাঁচ দিনের জন্য সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে মেঘালয়ে।
মেঘালয় ও আসামের বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে নামে সিলেটে। এই ঢলেই দেখা দেয় বন্যা। ভারতের এই দুই রাজ্যে ব্যাপক বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাউবো সিলেট কার্যালয়ের উপ নির্বাহী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, ‘যেভাবে ঢল নামছে, তাতে পানি আটকানোর কোনো উপায় নেই। আগামী দুই দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’
পানিতে বিদ্যুতের লাইন ও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র তলিয়ে যাওয়ায় নগরের অনেক এলাকাসহ কোম্পানীগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, গোয়ানঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। নগরের কুমারগাওয়ে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রেও পানি ঢুকে পড়েছে। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জের পুরোটা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাদির বলেন, ‘যেসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে, নিরাপত্তার স্বার্থেই ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কুমারগাও উপকেন্দ্র তলিয়ে গেলে দুই জেলার ৯০ শতাংশ সরবরাহই বন্ধ হয়ে পড়বে।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কুমারগাওয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। সেনাবাহিনীও এখানে কাজ করছে। সেনাবাহিনী বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করছে। আর ইতোমধ্যে কেন্দ্রে ঢুকে পড়া পানি সিটি করপোরেশনের সাকার মেশিন দিয়ে শুকানোর কাজ করা হচ্ছে। কারণ এই কেন্দ্র ডুবে গেলে সিলেটজুড়ে অভাবনীয় বিপর্যয় দেখা দিবে।’
সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা ভবনও পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন আন্তরিকভাবে কাজ করছে। যাদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নতুবা নিরাপদ স্থানে চলে আসতে বলা হচ্ছে। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সেনাবাহিনীও কাজ শুরু করেছে।’