গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোজ্য তেল আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১৫ দিন দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম নতুন করে বাড়বে না। তারও ১৫ দিন আগে আগের যে বৈঠক হয়েছিল, সেদিনও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, আগামী ১৫ দিনে দেশের বাজারে নতুন করে বাড়বে না ভোজ্য তেলের দাম। অর্থাৎ বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী চলতি জানুয়ারি মাসে ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি হওয়ার কথা নয়। অথচ ভোজ্য তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একরকম হঠকারিতা করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম বৃদ্ধিতে সায় না দেওয়ার পরও এভাবে সয়াবিনের দাম বৃদ্ধিকে প্রতারণা বলছেন বাজার বিশ্লেষকরা। ব্যবসায়ীদের এই হঠকারিতায় অবাক হয়েছেন বাণিজ্য সচিব তপন কুমার ঘোষও। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, বুধবারের বৈঠকে মিল মালিকরা আমাদের প্রতিশ্রুতি দেন, তারা লিটারপ্রতি যে ৮ টাকা দাম বাড়িয়েছেন অনুমতি ছাড়া তার পুরোটাই প্রত্যাহার করে নেবেন এবং আগামী ১৫ দিন নতুন করে আর দাম বাড়াবেন না। বৈঠক শেষে মন্ত্রীও সে ঘোষণা দেন। বৈঠকে তো ৩ টাকা দাম কমানোর কোনো কথা আসেনি। নতুন করে যদি দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে তাহলে সেটি ১৫ দিন পর যে বৈঠক হবে তখন- এটাই কথা হয়েছে বৈঠকে। অন্যদিকে বুধবারের বৈঠকে বসার আগেই বর্ধিত মূল্যের বোতলজাত সয়াবিন প্রস্তুত করে ফেলেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, বৈঠকের তিন দিন আগে ১৭ জানুয়ারি ১৬৮ টাকা মূল্য নির্ধারণ করেন ব্যবসায়ীরা। অথচ বাজারে তখন ১৬০ টাকা লিটার সয়াবিন তেল। বুধবারের বৈঠকে ৩ টাকা কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় পরদিন থেকেই বাজারে দুরকম মূল্য সংবলিত লেবেলের সয়াবিন সরবরাহ শুরু করা হয়। এক লিটার ১৬৫ ও ১৬৮ টাকা মূল্য দিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। এ ছাড়া ২ লিটারের মূল্য ধরা হয়েছে ৩২৮ টাকা, যা আগে ছিল ৩১৮ টাকা এবং ৫ লিটারের মূল্য ৮০০ টাকা করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৭৬০ টাকা।
এভাবে ব্যবসায়ীরা বৈঠকে বসে বলছেন একরকম কথা, আর বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহ করছেন চড়া দামে। অন্যদিকে এটাকে চরম হঠকারিতা বলছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, বাজারে ভোজ্য তেল নিয়ে চরম অরাজকতা দেখা দিয়েছে, সে সঙ্গে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে। কারণ বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, আগামী ১৫ দিন দাম বাড়বে না ভোজ্য তেলের। অথচ ব্যবসায়ীরা মন্ত্রীর কথার উল্টো কাজ করে দাম বাড়িয়ে বাজারে ছাড়ছেন তেল। এটা তো মোটেই কাম্য নয়। এভাবে হঠকারীর মাধ্যমে ব্যবসা করা ঠিক হচ্ছে না ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীদের।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বাণিজ্য সচিব বলেন, এই যে ৮ টাকা বাড়িয়েছিল তারা, তার অনুমতি তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেয়নি। তবে বিশ^বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে অনেকখানি। এ জন্য আমরা তাদের বলেছি, আমরা আরও তথ্য যাচাই-বাছাই করে ১৫ দিন পর নতুন সিদ্ধান্ত নেব; কিন্তু এই ফাঁকে তারা নিজেরাই দাম বাড়াল, আবার নিজেরাই ৩ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৫ টাকা এস্টাবলিশড করে ফেলল। বৃহস্পতিবার থেকেই তারা বাজারে ১৬৮ ও ১৬৫ টাকা লিটার দরের সয়াবিন বাজারে সরবরাহ শুরু করেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো দেশের বাজারে তারা এই মূল্যের সয়াবিন তেল সরবরাহ করবে। তারা কি এটা করতে পারে। ‘বৈঠকে ব্যবসায়ীরা আমাদের বিষয়টি বলেছিল; কিন্তু আমরা তাদের এই দামে বাজারে সয়াবিন সরবরাহ করতে নিষেধ করি। তারপরও যদি তারা বাড়তি মূল্যে সয়াবিন বাজারে দেয়, তাহলে আমরা কাল (আজ) থেকেই মনিটরিং টিম নামাব।’
‘ব্যবসায়ীরা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা যে ৮ টাকা বাড়িয়েছে তার পুরোটাই প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু তারা সেটি না করে ৩ টাকা কমিয়ে ১৬৫ টাকা করার কথা বলেছে, এটা তো হতে পারে না। প্রয়োজনে আগামী সপ্তাহে আমরা আবার বৈঠকে বসে বিষয়টি নিয়ে কী করা যায় দেখব।’ তবে ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা বলছেন উল্টো কথা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তাফা হায়দার সময়ের আলোকে বলেন, বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রীসহ অন্যদের সঙ্গে আমাদের যে কথা হয়েছে সেটি হলো- গত নভেম্বর মাসে আমরা লিটারে ১২ টাকা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ডিসেম্বরে কমিয়ে লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করি; কিন্তু আমাদের প্রস্তাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো রকম সাড়া দেওয়া হচ্ছিল না। পরে বাধ্য হয়ে চলতি জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখে আমরা লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকার বদলে ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করে সয়াবিন তেল বাজারজাত শুরু করলাম। যদিও এটা আমরা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই করেছি; কিন্তু আমরা বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিলাম বৈঠকে বসার জন্য এবং আলোচনার জন্য। সাড়া না দেওয়ায় আমরা বাধ্য হয়ে বাড়িয়েছি, কারণ সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় বাজারে বিশৃঙ্খলা হচ্ছিল। তা ছাড়া দাম না বাড়ালে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা যাচ্ছিল না। বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমে গিয়েছিল। এর সব বিষয়েই আমরা বুধবারের বৈঠকে আলোচনা করি এবং বাস্তবতাগুলো সবাই অনুধাবন করেন।
সব দিক বিবেচনা করে মন্ত্রী বললেন, তাহলে আমরা আবার আলোচনা করব। ১৫ দিন পর আমরা আবার বসব, তার আগ পর্যন্ত তিনি আমাদের কিছুটা ছাড় দিতে বললেন। মন্ত্রীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা লিটারে ৩ টাকা কমিয়ে ১৬৫ টাকা নির্ধারণ করলাম। এখন এই দামেই বিক্রি হবে সয়াবিন তেল।