
রমজান মাস এলেই বাজার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ে সাধারণ মানুষের। এ সময় ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। রমজানের এখনো এক মাসের বেশি সময় বাকি। অথচ এরই মধ্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ছোলা, অ্যাংকরসহ মসুর ডালের বাজার। আমদানি কম দেখিয়ে রাজধানীর খুচরা বাজারে ইতোমধ্যেই ছোলার দাম বেড়ে শতকের ঘরে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে গরিবের অ্যাংকর ডালের দামও বেড়ে ৭৫ টাকায় ঠেকেছে। ছোট দানার মসুরের দাম বেড়ে ১৪০ টাকা ছুঁয়েছে আগেই। বর্তমানে তেতে আছে মোটা দানার মসুরের বাজারও।
দেশি ইফতার আয়োজনে ছোলা-মুড়ির প্রচলন দীর্ঘদিনের। পাশাপাশি ভাজা-পোড়া পদ তৈরিতে বেসনের ব্যবহারও বেড়ে যায়। ফলে রমজান মাসে ছোলার চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ছোলার দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এবার রোজার এক মাস আগেই ছোলার দাম বেড়ে রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। দেশের বাজারে এখন পর্যন্ত এটিই ছোলার সর্বোচ্চ দাম। যদিও কোথাও কোথাও এর বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, মাত্র ২০ দিন আগেও ছোলার কেজি বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকায়। সব থেকে ভালো মানেরটা বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়।
মালিবাগ বাজারের বিপ্লব স্টোরের ব্যবসায়ী মো. সোলায়মান জানান, মাসখানেকের ব্যবধানে ছোলার দাম বেড়ে ১০০ টাকায় পৌঁছেছে। পাইকারিতে এখন প্রতিবস্তা (২৫ কেজি) কেনা পড়ছে ২ হাজার ২৭৫ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিকেজি কেনা পড়ছে ৯১ থেকে ৯২ টাকা। দুই মাস আগেও ১ হাজার ৮৭৫ টাকায় বস্তা কেনা যেত। তখন প্রতিকেজিতে কেনা দাম পড়ত ৭৫ টাকা। তার আগে ৭০ টাকাও ছিল।
একই কথা জানান কদমতলী সাদ্দাম মার্কেট বাজারের মিলন স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মিলনও। তিনি বলেন, দেড় সপ্তাহ আগে কেনা ছোলা এখন বিক্রি করছি ১০০ টাকা। প্রতিকেজি কেনা পড়েছে ৯০ টাকা। আজকেও পাইকারিতে দাম বেড়েছে। মাসখানেক আগেও ৮২ টাকা কেজি দরে কিনতে পেরেছি। এখন ৯০ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না।
কারওয়ানবাজারের বিউটি স্টোরের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনও বলেন, খুচরায় ছোলার দাম বেড়ে এ বাজারে মানভেদে ৯০ থেকে ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কিছুদিন আগেও ৮৫ টাকাতে বিক্রি হয়েছে। বাজারে এখন নতুন যে ছোলা আসছে সেগুলো ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
কথা হলে বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ জানান, ছোলার দাম বেড়ে রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, রোজায় বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখে এ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইথিওপিয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ডালের আমদানি বাড়ায় আমদানিকারকরা। কিন্তু বর্তমানে ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে আমদানি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে দাম বেশি এবং ডলারের দাম বাড়ায় আমদানিতে খরচও বেশি। এর প্রভাব দামের ওপরেও পড়েছে। আমরা তো আর লোকসান দিয়ে ব্যবসা করব না।
তিনি বলেন, গত রোজার তুলনায় পাইকারিতে ছোলার দাম ২২ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। গতবার প্রতিকেজি আমরা ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি করতে পেরেছি। এখন ৮২-৮৫ টাকার নিচে বিক্রি করার সুযোগ নেই। অ্যাংকর ডালের দামও বেড়েছে। এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ টাকা। একইভাবে আমদানিকৃত মসুর ডালের বাজারও চড়া।
রাজধানীর খুচরা বাজারে মাসখানেকের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে অ্যাংকর ডাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত মাসে যা ৬৫ টাকায় পাওয়া গেছে। অপরদিকে মোটা দানার মসুর ডাল এতদিন ৯৫ টাকাতে পাওয়া গেলেও বর্তমানে অনেক দোকানেই ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা জানান, পাইকারিতে মোটা দানার মসুরের দাম বর্তমানে চড়া রয়েছে।
অ্যাংকর ডালের দাম বাড়ায় আক্ষেপ বেড়েছে দিনমজুর মো. আওলাদ হোসেনের। কারওয়ানবাজারে ডাল কিনতে এসে তিনি বলেন, ‘মসুর ডাউলের চেয়ে কম দাম হওয়ায় এত দিন অ্যাংকর ডাউল খাইছি। এহন সেইটার দামও বাইড়া ৭০-৭৫ টাকা হইছে। যা দেখতাছি তাতে ডাউল খাওয়াই ছাইড়া দিতে হইবো।’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও ডালের বাজারের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটির হিসাব বলছে, ছোলার বর্তমান বাজার মূল্য ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। গত সপ্তাহে যা বিক্রি হয় ৮৫ টাকায় এবং গত বছর পণ্যটি ৭০ টাকাতে বিক্রি হয়েছে। অ্যাংকর ডালের বর্তমান মূল্য ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। গত মাসে যা ৬৫ টাকায়ও পাওয়া গেছে। আর এক বছর আগে এই সময়ে এ ডাল ৪৮ টাকাতেও কেনা গেছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, রমজান মাসে দাম কমার কথা। সেখানে উল্টো দাম বেড়ে যায়। বাজারে নৈতিক ব্যবসার বদলে লোভ বাড়ছে। এতে ভোক্তাদের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে। রোজায় সাধারণ মানুষ যাতে একটু স্বস্তি পেতে পারে সেদিকে এখন নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ছাড় দেওয়া যেতে পারে। রোজাকে কেন্দ্র করে পণ্যের দাম যাতে অযৌক্তিকভাবে না বাড়ে সেদিকেও কড়া নজরদারি থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পণ্যের সরবরাহ যাতে স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলে দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারবে না।