সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না পাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজ মানবাধিকারের কথা বলা হয়। সরকারের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। ১৫ আগস্ট আমরা যাঁরা আপনজন হারিয়েছি; সেই সময়ে মানবাধিকার কোথায় ছিল? আমি মা-বাবা হারিয়েছি। বিচার চাইতে পারব না। মামলা করতে পারব না। আমরা মানুষ নই?’
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত- এমন অভিযোগ পুনর্ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, জিয়াউর রহমান জড়িত না থাকলে খুনিদের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে সহযোগিতা এবং বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করতেন না। তিনি খুনি ও ষড়যন্ত্রকারী না হলে খুনি মোশতাক তাঁকে সেনাপ্রধান বানাত না।
মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংকটের কারণে প্রায় তিন বছর পর তিনি সশরীরে গতকালের আলোচনা সভায় উপস্থিত হলে নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরেও হাজার হাজার নেতাকর্মী হাত নেড়ে ও গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান।
র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেই দেশই তো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। অথচ তারাই আমাদের মানবাধিকারের সবক দিচ্ছে। এটাই দুর্ভাগ্য।’ তিনি বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুসহ নারী-শিশুদের হত্যা করেছে, তারাই মানবাধিকারের কথা বলে। আর বিএনপি তাদের লালনপালনকারী। আমার প্রশ্ন- আমাদের মানবাধিকার কোথায়? আমাদের মামলা করারও অধিকার ছিল না। কারণ ইনডেমনিটি দিয়ে খুনিদের পুরস্কৃৃত করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রবাসে ছয় বছরের নির্বাসন ও ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পরও দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে। দেশে ফিরে এসেও বিচার চাইতে পারিনি। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে আদালতে গিয়ে বিচার চেয়েছি। ওই সময়ে ক্ষমতায় না এলে আমরা ইনডেমনিটি বাতিল করতে পারতাম না। বিচারের উদ্যোগও নিতে পারতাম না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কখনও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতো না।
দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া; বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারসহ বিভিন্ন মহলের বাধা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও এই বিচারের রায় কার্যকরের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালের ৬ নভেম্বর যেদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় হবে; সেদিনও হরতাল ডেকেছিল বিএনপি, যাতে বিচারক আদালতে যেতে না পারেন। ভাষণের এক পর্যায়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার নৃশংসতম ঘটনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচে থাকাটা যে কত কষ্টের!
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান নিজে উদ্যোগী হয়ে খুনিদের লিবিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে সহযোগিতা করেছিলেন। পাকিস্তানের ভুট্টোকে অনুরোধ করে তাঁর মাধ্যমে গাদ্দাফির সঙ্গে আলোচনা করে খুনিদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কথিত সুশীল বলে পরিচিত ব্যারিস্টার মইনুল বঙ্গবন্ধুর খুনি পাশা ও হুদাকে নিয়ে প্রগশ নামে রাজনৈতিক দল করেছিলেন। এরশাদ ক্ষমতায় এসে খুনি ফারুককে ফ্রিডম পার্টি করার সুযোগ দেন; রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেন। খালেদা জিয়া আরেক ধাপ ওপরে। তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনে খুনি রশিদ-ফারুক-হুদাকে নির্বাচনের সুযোগ দেন। খুনি রশিদকে বিরোধী দলের নেতার আসনে বসান। সুতরাং এরা কী করে বলবেন- তাঁরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না?
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেন আওয়ামী লীগের কোনো নেতা প্রতিবাদ করতে পারলেন না- এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, জাতির পিতা তো অনেককে ফোনও করেছিলেন। তখন কোথায় ছিলেন তারা? ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে লাশগুলো তো পড়ে ছিল। একটি মানুষ ছিলেন না সাহস করে এগিয়ে আসার? একটি মানুষ ছিলেন না প্রতিবাদ করার? কেন করতে পারেননি?
তিনি আরও বলেন, এত বড় সংগঠন, এত লোক! কেউ তো একটা কথা বলার সাহসও পাননি। আসলে বেঁচে থাকতে সবাই থাকে। মরে গেলে যে কেউ থাকে না, এটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই আমিও কিছু আশা করি না। সবাইকে হারিয়ে বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা যে কত যন্ত্রণার, যাঁরা এভাবে বেঁচে আছেন, তাঁরাই শুধু জানেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত লাশগুলো পড়ে থাকল। ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মরদেহ নেওয়া হলো টুঙ্গিপাড়ায়। সেখানে মা-বাবার কবরের পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু গরিব মানুষকে যে রিলিফের কাপড় দিয়েছিলেন, সেই কাপড়েই তাঁকে কাফন দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কিছুই নিয়ে যাননি। শুধু দিয়ে গেছেন। তিনি একটি দেশ, একটি জাতি ও পরিচয় দিয়ে গেছেন। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে উন্নয়নের পথে যাত্রা করিয়ে দিয়ে গেছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটের মুখে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করতে হয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, একদিকে তেলের দাম বাড়ছে। প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ছে। উন্নত দেশগুলোরও একই অবস্থা। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে আরও খারাপ পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে আমরা বাধ্য হয়েছি তেলের দাম বাড়াতে। এতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। তাই সরকার ৫০ লাখ পরিবারের মাঝে মাত্র ১৫ টাকায় চাল সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১ কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হবে। যার মাধ্যম সাশ্রয়ী মূল্যে চাল, ডাল, চিনি যার যেটা প্রয়োজন, সেটা তারা কিনতে পারবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এখন বিশ্বব্যাপী মন্দাভাব ও অনেক জায়গায় দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবারই কিছু করণীয় আছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে কোনো মানুষ কষ্ট পাক, তা আমরা চাই না। তাই দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি যাঁরা বিত্তবান, তাঁদের প্রতি আহ্বান- নিজ নিজ এলাকায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। তাঁদের সহযোগিতা করুন। সরকার থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে।
মানুষের জন্য তাঁর সরকার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর উপহার দিচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইনশাআল্লাহ, একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না।
জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করে দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। তাই সব যন্ত্রণা সহ্য করে নীলকণ্ঠি হয়ে অপেক্ষায় ছিলাম, কখন ক্ষমতায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারব। এই দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছি। আর দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত প্রতিশোধ নিতে পারব। বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে পারে না, যাবে না।
আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আরও বক্তব্য দেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী এবং উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। সঞ্চালনা করেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।