সদ্য স্বাধীন দেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত অর্থনীতি। চারদিকে শুধুই হাহাকার। ১৯৭২ সালের পয়লা মাসেই বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন। ১৯৭২-৭৫ মাত্র চার বছরের শাসনামলে গোটা দেশকে পরিবর্তনের পরিকল্পনা করেছিলেন।
সব খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতেও তিনি দূরদর্শী উন্নয়নের যাত্রা শুরু করেছিলেন। স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যকে দেয়া হয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব। প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবায় দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব।
চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান, জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠন, নতুন নতুন গবেষণা, শিক্ষা ও সেবাদান প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। শুধু চিকিৎসক নয়, নার্স, টেকনোলজিস্ট এমনকি ওষুধশিল্পেও বঙ্গবন্ধু যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি সময়োপযোগী ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও ১০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিশ্বে আজও সমাদৃত। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা আর বাসস্থানের মতো চিকিৎসাকে ১৯৭২-এর সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করেছেন। ওই সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদে পর্যাপ্ত পুষ্টি প্রাপ্যতাকে মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
আইপিজিএমআর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল হিসেবে স্থাপন করেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার ক্ষেত্রে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শাহবাগে শিফট করা হয় তখন শয্যা সংখ্যা ছিল ৩০০টি। জাতির পিতা এটা আরও বাড়িয়ে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করেন। মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন সাবজেক্ট, সাবস্পেশালিস্ট সাবজেক্ট পর্যন্ত চালু করেছেন।
১৯৭২ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি কার্ডিও ফিজিওলজি ল্যাব প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১৯৭৮ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু ডা. আর জে গ্যাস্টনকে আমন্ত্রণ জানান এবং অর্থোপেডিক সার্জারি বিষয়ে ট্রেনিংয়ের জন্য একটি টিমকে পূর্ব জার্মানি প্রেরণ করেন।
এরপর ১৯৭২ সালে ডা. আর জে গ্যাস্টনকে পরিচালক করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অস্থায়ীভাবে পঙ্গু হাসপাতালের কার্যক্রম চালু করেন। পঙ্গু হাসপাতালে অর্থোপেডিক সার্জারির ওপর এমএস ডিগ্রি চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বেশ সচেতন ছিলেন।
তাই ১৯৭২ সালে প্রয়াত অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু রাজধানীতে ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষার ডিগ্রিগুলো ব্রিটিশ জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল একে একে স্বীকৃতি বাতিল করে দেয়।
ফলে ইংল্যান্ডে গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষালাভের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। জাতির পিতা তখন ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। বিদেশ থেকে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস করেছেন এমন ৫৪ জন ফেলো নিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অব সার্জনস (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন। গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) বঙ্গবন্ধুর সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়।
চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন প্রদান, মনিটরিং ও তত্ত্বাবধায়নের জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) প্রতিষ্ঠা। চিকিৎসকদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান। আগে যা দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় ছিল। একজন চিকিৎসককে প্রথম স্বাস্থ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান।
১৯৭৪ সালে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ পুষ্টি পরিষদ গঠনের আদেশে স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শিক্ষাদান, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পরামর্শ প্রদান।
এই চারটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে মহাখালীতে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) প্রতিষ্ঠিত হয়। নার্সিংসেবা ও টেকনোলজির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।