এক রাতের অভিযানে দুই আলোচিত মডেল পিয়াসা ও মৌকে গ্রেফতার করায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে শো বিজ জগতে। রাতগভীরে অভিজাত এলাকার প্রমোদকুঞ্জে ‘ডেটিং স্পটের’ নামে বিত্তবান ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও ধনীর দুলালদের ব্ল্যাকমেল করার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগেই তাদের ধরা হয়। এ ধরনের আরও তিন আলোচিত নারীকে আটক করার জন্য গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোন সময় আটক করা হতে পারে তাদেরও। এদিকে পিয়াসা ও মৌকে পৃথক পৃথক মামলায় ৩ দিন করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ডিবিতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। রবিবার রাতেই রাজধানীর বারিধারা থেকে ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসা থেকে মরিয়ম আক্তার মৌকে আটক করার পর তাদের বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। পিয়াসাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আলমগীর সিদ্দীক। আসামিপক্ষে আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম রিমান্ডের এ আদেশ দেন। অন্যদিকে মডেল মরিয়ম আক্তার মৌয়ের (মৌ আক্তার) তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আশেক ইমাম শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দেন। বিকেল তিনটা ৪০ মিনিটে ঢাকা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে তিনি মৌয়ের দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন।
জানতে চ্ইালে ডিবির একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা সোমবার দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, রিমান্ডে থাকা পিয়াসা ও মৌ বেশ আলোচিত নানা কারণেই। তাদের মধ্যে পিয়াসা হচ্ছেন- আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী। তখনও তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে সাফাতকে ব্ল্যাকমেল করার অভিযোগ করেছিল তার সাবেক শ্বশুর দিলদার আহমেদ। যদিও পরে পরিস্থিতি উভয়ের জন্য আত্মঘাতী মনে হওয়ায় চেপে যান পিয়াসা। বারিধারা যেই বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা ছিল রীতিমতো একটি মিনিবারের মতো। প্রতিরাতে এখানেই বসানো হতো ডেটিং স্পট নামের একটি বিশেষ আসর যেখানে হাজির হতেন রাজধানীর আলোচিত দুই শিল্পপতিসহ উঠতি বয়সের ধনীর দুলালেরা। তাদের জন্য পিয়াসা এখানে সরবরাহ করতেন সব ধরনের মাদক। নামীদামী ব্র্যান্ডের বিদেশী মদ বিয়ার ছাড়াও থাকত ইয়াবা, গাঁজা ও চরসের মতো ভয়ঙ্কর মাদক। তরুণ তরুণীরা এসবেই বেশি আগ্রহী থাকায় ওই বাসায় সরবরাহ করা হতো। রাতে তাদের উদ্দাম নৃত্যের ঝঙ্কার আর নেশায় মত্ত নিরাপদ আয়োজন করে দিয়ে গোপনে সেদৃশ্য ভিডিও করতেন পিয়াসা। পরে সময়মতো সেগুলো দেখানোর পর ওরা আঁতকে উঠত। মান সম্মানের ভয়ে তারাই এসবের সমঝোতা করত মোটা অঙ্কের টাকা ও উপহারের বিনিময়ে। এ ধরনের ব্ল্যাকমেল অনেকে চেপে গেলেও গত সপ্তাহে বেঁকে বসেন এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। যিনি সরাসরি তার এক ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার শরণাপন্ন হন। মূলত তারপরই ওই বাসায় অভিযান চালানো হয়। একই কারণে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় মরিয়ম আক্তার মৌকে। তার বাসাতেও বসত নিয়মিত মদের আসর আরও কপোত কপোতির সম্মিলন। তিনিও পিয়াসার মতো একই কায়দায় প্রভাবশালী ও বিত্তবান তরুণ তরুণীদের আপত্তিকর দৃশ্য ভিডিও করে রাখতেন। পরে সময়মতো যাকে যেভাবে ইচ্ছে ব্ল্যাকমেল করতেন।
জানা গেছে এ দুজনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ হাতে নিয়ে বেশ কিছু দিন গোয়েন্দা নজরদারি চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েই রবিবার রাতে অভিযান চালানো হয়। ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মহিদুল ইসলাম জানান, কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বারিধারার ৯ নম্বর রোডের ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ পিয়াসাকে আটক করা হয়। আর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অভিযান চালিয়ে মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে (মৗ আক্তার) আটক করা হয়।
ডিবি জানায়, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার বাসায় অভিযান চালিয়ে বিদেশী মদ, ইয়াবা ও সিসা উদ্ধার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের একটি দল বারিধারার ৯নং রোডের ৩নং বাসায় অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় পিয়াসার ঘরের টেবিল থেকে চার প্যাকেট ইয়াবা জব্দ করে ডিবি। এছাড়া পিয়াসার রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে নয় বোতল বিদেশী মদ উদ্ধার করা হয়। অভিযানের একপর্যায়ে পিয়াসার ফ্রিজ খুলে একটি আইসক্রিমের বাক্স থেকে সিসা তৈরির কাঁচামাল ও বেশ কয়েকটি ই-সিগারেট পাওয়া যায়। তার কাছ থেকে চারটি স্মার্টফোনও জব্দ করা হয়। অভিযানের সময় পিয়াসাকে একটি রুমে আটক রাখা হয়। তার সঙ্গে ডিবির দুজন নারী অফিসার ছিলেন। অভিযান শেষে পিয়াসাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে ডিবি অফিসে নেয়া হয়। ডিএমপির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম বলেন, কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তার বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। তাকে আটক করা হয়েছে। একই রাতের অভিযানে মৌকে আটক করা হয়। তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মদ ও বিয়ার উদ্ধার করা হয়।
এদিকে গ্রেফতারের পর গাড়িতে তোলার সময় মৌ সাংবাদিকদের বেশ সজোরে বলতে থাকেন, আমাকে ষড়যন্ত্র করে মদ দিয়ে ধরানো হুমকি দিয়েছিলেন ভাসাবির মালিক জামানের স্ত্রী তানজি। ওর মাধ্যমেই পিয়াসার সাথে আমার পরিচয় হয় । সম্প্রতি ওদের মধ্যে কারোর সাথে একটা ঝামেলা হয়েছে যে জন্য আমাকে সন্দেহ করে তানজি হুমকি দেয় মদ ও ইয়াবা দিয়ে ধরানোর। সেটাই হয়েছে। পুলিশ আমাকে এগুলো দিয়েই ধরেছে।
মৌয়ের এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভাসাবির মালিক জামান গত সন্ধ্যায় দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এটা কিভাবে সম্ভব। পুলিশের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা কি কারোর কথা বা ইন্ধনে মদ বিয়ার হাতে করে নিয়ে গিয়ে এভাবে কাউকে ফাঁসায়? আপনারা গণমাধ্যমের কর্মীরাই তো ওই রাতের প্রত্যক্ষদর্শী। আমরা দেখেছি টিভিতে আপনাদের উপস্থিতিতেই সেই রাতের মৌয়ের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে একের পর এক বোতলগুলো বের করা হয়েছে। এমন তো নয় পুলিশ গোপনে এ অভিযান চালিয়েছে। পুলিশ তো স্বচ্ছতার ভিত্তিতেই এ অভিযানের মাধ্যমে তাকে মাদকসহ গ্রেফতার করেছে। আসলে এগুলো সবই তার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা। হয়তো ভাসাবিতে কেনাকাটা করতে এসে আমার স্ত্রীর সাথে তার পরিচয় হয়েছে। পরে কিছু হাতানোর জন্য তাকে ঘায়েল করার জন্যই এমন দোষারোপ।
এদিকে এই দুই নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ও মামলা সম্পর্কে জানা যায়, গুলশান থানায় মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে আসামি করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটা মামলা দায়ের করা হয়? ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ২-৩ জনকে আসামি করা হয়। একইভাবে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার হওয়া মডেল মরিয়ম আক্তার মৌয়ের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। সাইবার এ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক শিশির কুমার কর্মকার বাদী হয়ে এই মামলাটি দায়ের করেন। উভয় মামলার এজাহারে সুস্পষ্টভাবে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা অপকর্ম ও অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার (নম্বর-৩) এজাহারে উপ-পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম উল্লেখ করেন, রবিবার রাত ৯টা ২৫ মিনিটে নতুন বাজার এলাকায় অবস্থান করার সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি যে, কতিপয় মাদক কারবারি অবৈধ মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করতে নিজ নিজ হেফাজতে নিয়ে গুলশানের বারিধারা ডিপ্লম্যাটিক জোনের ৯ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাসায় অবস্থান করে আছেন। এমন সংবাদ যাচাই করতে সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে সেখানে যাই।
অপরদিকে মরিয়ম আক্তার মৌয়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা মাদক মামলার এজাহারে মামলার বাদী পরিদর্শক শিশির কুমার কর্মকার উল্লেখ করেন- রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে মোহাম্মদপুর থানাধীন বাবর রোডের ২২৯ বাসার নিচ তালার রুমে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্যসহ এক নারীকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তার নাম মরিয়ম আক্তার মৌ। মডেল মৌয়ের ঘরে কাঠের তৈরি ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ার থেকে নীল রঙের জিপার যুক্ত ৫টি প্যাকেটে মোট ৭৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, মাস্টার বেডরুমের বাথরুমের ভেতর থেকে বিভিন্ন ব্রান্ডের ১২ বোতল বিদেশী মদ, বাসার ড্রয়িং রুমে দেয়ালের কাঁচের আলমিরা থেকে মদ পানের জন্য ব্যবহৃত ১০টি লং কাঁচের গ্লাস, ১২টি কাঁচের গ্লাস, ১টি স্টিলের আইস বক্স, কাঁচের খালি বোতল ১টি জব্দ করা হয়।
ওরা রাতের রানী ॥ এদিকে গ্রেফতারের পর ডিবি এক প্রেস ব্রিফিংয়ের জানায়, আটক হওয়া দুই মডেল একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা উচ্চবিত্তদের ব্ল্যাকমেলিং করতেন। মোহাম্মদপুরে মৌয়ের বাড়ির নিচে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবি উত্তর বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর রশীদ তারা দুজন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ পেয়েছি। সেসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। দুজনের বাসায় বিদেশী মদ, ইয়াবা ও সিসা পাওয়া গেছে। মৌয়ের বাড়িতে মদের বারও ছিল। তারা দুজনই মডেল হচ্ছেন রাতের রানী। তারা দিনের বেলায় ঘুমান এবং রাতে এসব কর্মকাণ্ড করেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে আনতেন তারা। বাসায় আসলে তারা তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। পরবর্তীতে তারা সেসব ভিডিও ও ছবি ভিক্টিমদের পরিবারকে পাঠাবে বলে ব্ল্যাকমেল করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতেন। তিনি আরও বলেন, বাসায় মাদক পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর ও গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক মামলা হবে।
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।