করোনা অতিমারির মধ্যে তিনটি নিরানন্দ ঈদ কাটিয়েছে দেশের মানুষ। এর মধ্যে গত ঈদুল ফিতরের সময় কঠোর লকডাউন থাকলেও গ্রামমুখী মানুষের স্রোত ঠেকানো যায়নি। তাই এবারের কোরবানির ঈদ সামনে রেখে চলমান লকডাউন সপ্তাহখানেকের জন্য শিথিলের চিন্তা করছে সরকার। কিছুদিনের জন্য গণপরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথাও ভাবছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সরকারের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের সূত্র থেকে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে। এখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সবুজ সংকেত পেলেই জারি করা হবে প্রজ্ঞাপন।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব কিছু স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে নমনীয় সরকার। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সবার সঙ্গে বৈঠক করে ঈদকেন্দ্রিক এই শিথিলতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা। মাঠ পর্যায় থেকে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত
প্রতিবেদনেও লকডাউন নিয়ে মানুষের নেতিবাচক অবস্থানের প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে লকডাউনে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠার খবরও পাচ্ছে সরকার। সব দিক আমলে নিয়ে ঈদ ঘিরে এক সপ্তাহের জন্য দোকানপাট, শপিং মল, গণপরিবহনসহ সব কিছু স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারটি বিবেচনায় নিতে পারে সরকার। এ বিষয়ে যুক্তি দিয়ে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রীর শর্ত দিয়ে ভাড়া বাড়ানো হলেও পরিবহন শ্রমিকরা সব সিটে যাত্রী নেয়। সেই সঙ্গে বাড়তি ভাড়াও নেয়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবার এক সপ্তাহের শিথিলের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা জোর দিয়ে বলা থাকবে, তবে বিশেষ কোনো বিধি-নিষেধ রাখা নাও হতে পারে।
অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল রবিবারও সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের করোনা ঢেউয়ের চূড়ায় (পিক) যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটা বাড়বেই। এই বাড়ার মধ্যেও ঈদ ঘিরে মানুষের যাতায়াত কমানো সরকারের পক্ষে অসম্ভব। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই লকডাউন শিথিলের ব্যাপারটি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করা প্রয়োজন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মন্ত্রিপরিষদসচিবের নেতৃত্বে ডজনখানেক সচিব, আইজিপি, পিএসও, আইইডিসিআর, করোনাসংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যসহ উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক গেল শনিবার অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে লকডাউন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই একমত হয়ে বলেন, ঈদ ঘিরে মানুষের চলাচল চেষ্টা করেও ঠেকানো যাবে না। বন্ধ রাখলেও মানুষ ঠাসাঠাসি করে নদী পার হয়, ট্রাক ও ভ্যানে করে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। এতে একদিকে আদেশ অমান্য হলেও সরকার কঠোর হতে পারে না। অন্যদিকে সরকারকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তাই ঈদে তুলনামূলক স্বস্তিতে যাতে মানুষ চলাফেরা করতে পারে—এ জন্য সীমিত পরিসরে গণপরিবহন খুলে দেওয়া উচিত।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী লকডাউনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান কঠোর বিধি-নিষেধ ঈদের আগেও থাকবে কি না, তা করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তার ওপর নির্ভর করছে। করোনাসংক্রান্ত কারিগরি পরামর্শক কমিটি পরামর্শ দিলে বিধি-নিষেধ আরো এগিয়ে নেওয়া হতে পারে। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছানি বাংলাদেশ।
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ফেরি এখনো চালু আছে। জরুরি প্রয়োজনে ফেরি চলছে। গণপরিবহন চলার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয় কি না, সেটা এখনো বলার মতো অবস্থা হয়নি। জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ কী বলে সে অনুসারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতি লকডাউন তুলে নেওয়ার মতো নয়, এটা সত্যি। কিন্তু কোরবানির ঈদে মানুষকে চাইলেও আটকে রাখা যাবে না, এটাই বাস্তবতা—এসব চিন্তা করেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
সচিবালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, ১১ দিনের লকডাউন পর্যায়ক্রমে ঢিলা হচ্ছে। সামনে ঈদ, মানুষকে পর্যাপ্ত ত্রাণও দেওয়া যাচ্ছে না। সেখানে এত বেশি কঠোর লকডাউনে গেলে সরকারকে বাজে পরিস্থিতি সামলাতে হতে পারে। এসব চিন্তা করেই সরকার ঈদ ঘিরে সাত দিনের ছাড় দিতে চিন্তা করছে।
এদিকে কোরবানির পশুর হাটে মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সবাইকে অনলাইনে পশু কিনতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আগেই একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
ঢিলেঢালা হতে শুরু করেছে লকডাউন : দেশে যখন সংক্রমণ চূড়ায় উঠেছে তখনই কঠোর লকডাউন ফের ঢিলেঢালা হতে শুরু করেছে। গত ১ জুলাই থেকে প্রথম সাত দিন যতটা কড়াকড়ি পরিস্থিতি ছিল, পরের সপ্তাহের তিন দিনে মানুষ আবার নেমে পড়েছে রাস্তাঘাটে। বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা, দোকানপাটও খুলতে শুরু করেছে। জরুরি প্রয়োজনের বাইরেও সাধারণ কাজে মানুষের ছোটাছুটি আটকানো যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। পথে পথে চেকপোস্ট, গাড়ি জব্দ, গ্রেপ্তার—কোনো বাধাই যেন মানতে চাইছে না এক শ্রেণির মানুষ।
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১ জুলাই থেকে সরকারি ভাষায় কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করা হয়। চলমান লকডাউনের সময় আগামী বুধবার পর্যন্ত নির্ধারিত আছে।
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।