সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৪৯৫ জন।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৪৯৫ জন।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় শিরায় প্রয়োগের স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে বাজারে। গত এক মাসে দেশে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় বাজারে এই সংকট দেখা দিয়েছে।
ডেঙ্গু রোগীর দেহে পানিশূন্যতা ও রক্তের ঘনত্ব স্বাভাবিক রাখতে রোগীর শিরায় নরমাল স্যালাইন প্রয়োগ করতে হয়। গতকাল রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন এলাকা ও শ্যামলীর বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে এ সংকটের বিষয়টি জানা যায়। ওষুধের দোকান মালিকরা বলছেন, দুই সপ্তাহ ধরে স্যালাইন সরবরাহ বন্ধ।
দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং সদর হাসপাতালগুলোতে ওষুধ ও স্যালাইন সরবরাহ করে এসেনশিয়াল ড্রাগস কম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)। তবে প্রতিষ্ঠানটির স্যালাইনের নিজস্ব উৎপাদন না থাকায় বিভিন্ন বেসরকারি কম্পানি থেকে তা কিনে হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করছে।
ইডিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবির বলেন, গত বছর ৬০ লাখ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা ছিল। এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি বেড়েছে। এ চাহিদা পূরণ করেছে বেক্সিমকো, স্কয়ার, একমি, পপুলার, ওরিয়ন, লিব্রা ও অপসোনিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন স্যালাইন লাগছে গড়ে এক হাজার ৫০০ ব্যাগ। অন্য হাসপাতালগুলোর মধ্যে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮০০ থেকে এক হাজার ব্যাগ, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৬০০ থেকে ৭০০, ঢাকা শিশু হাসপাতালে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ ব্যাগ লাগছে।
ঢাকার দুই হাসপাতালে স্যালাইন পরিস্থিতি
গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) গিয়ে কল্যাণপুরের মোহাম্মদ আলমগীরের সঙ্গে কথা হয়। হাসপাতালের এফ ব্লকের পুরুষ ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ১৩ নম্বর শয্যায় তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত পাঁচ ব্যাগ স্যালাইন লেগেছে। এর মধ্যে তিন ব্যাগ হাসপাতাল থেকে দিয়েছে। দুই ব্যাগ নিজে কিনেছি। এই স্যালাইন কিনতে গিয়ে অনেক ঘুরতে হয়েছে। কারণ ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন নেই।’
পাশের শয্যায় ভর্তি মিরপুরের বাসিন্দা ফরহাদ জানান, এ পর্যন্ত বেশির ভাগ ওষুধ কিনতে হয়েছে ফার্মেসি থেকে। হাসপাতাল থেকে তাঁকে শুধু দুটি স্যালাইন ছাড়া কিছুই দেওয়া হচ্ছে না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, রোগীরা বেশির ভাগ স্যালাইন পাচ্ছে হাসপাতাল থেকে। তবে বিশেষ কারণে কয়েকজন রোগীকে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে ফার্মেসি থেকে। এদের একজন আশরাফুল হাসান। তিনি ভর্তি মেডিসিন বিভাগের ৬০২ ওয়ার্ডের ৫২ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন।
আশরাফুলের স্বজন জানান, প্রথম স্যালাইনটি হাসপাতাল থেকে দেওয়া হলেও দ্বিতীয়টি তাঁদের কিনতে হয়েছে।
প্রধানত শিরায় চার ধরনের স্যালাইন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাধারণ বা নরমাল স্যালাইন ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কিছু স্যালাইন রয়েছে হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য। অন্য এক ধরনের স্যালাইনকে বলে গ্লুকোজ স্যালাইন, যা দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োগ করা হয়। আবার কলেরা বা ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্য একটি স্যালাইন ব্যবহার করা হয়।
হাসপাতালে স্যালাইনসংকট নেই
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, এখনও পর্যন্ত হাসপাতালে স্যালাইনের কোনো সংকট নেই। রোগীদের প্রয়োজনীয় স্যালাইন হাসপাতাল থেকেই দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন প্রতি মাসে এক লাখ ব্যাগ স্যালাইন লাগে। ডেঙ্গু আসার পর থেকে ৪০-৪৫ হাজার ব্যাগ বেশি লাগছে। অর্থাৎ প্রতিদিন রোগীভেদে স্যালাইন প্রয়োজন হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ব্যাগ।’
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে প্লেইন বিছানায় যেসব রোগী আছে, তাদের স্যালাইন কিনতে হয়। ফ্রি বিছানায় থাকা রোগীদের আমরা হাসপাতাল থেকে স্যালাইন দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত স্যালাইনের কোনো সংকট হয়নি। তবে চাহিদা অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন সব মিলিয়ে চার শর বেশি স্যালাইন লাগছে।’
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার এখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে ৫০০ জনের বেশি। এসব রোগীর প্রতিদিন দুই ব্যাগ স্যালাইন লাগে। এর বাইরে অন্য রোগীদের এই স্যালাইন খুব বেশি লাগে না। সব মিলিয়ে ৮০০ থেকে এক হাজার ব্যাগ স্যালাইন প্রতিদিন লাগে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো সংকট নেই।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীর কারণে স্যালাইনের চাহিদা দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। প্রতিদিন রোগীভেদে ব্যাগ দিতে হয়। চাহিদা আছে ৪০০ থেকে ৫০০ ব্যাগ। এখনো কোনো সংকট হয়নি। মজুদ আগে থেকেই ছিল।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রশিদ উন নবী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিদিন ৭০০ ব্যাগ স্যালাইন লাগছে। এটি অন্য সময়ের তুলনায় তিন গুণ বলা যায়। তবে সংকট নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি রোগী গড়ে তিন দিন থাকছে। হাসপাতালের বাইরে অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদেরও স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। ফলে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়। পাশাপাশি রক্তচাপও কমে যায়। তাই রক্তের চাপ স্বাভাবিক রাখতে ও রক্তে তারল্য ঠিক রাখতে রোগীকে স্যালাইন দেওয়া হয়।
হাসপাতালে ভর্তি ৯৩৩৪
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল ভর্তি নতুন রোগীদের নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৯ হাজার ৩৩৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চার হাজার ৬৮০ জন। অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে চার হাজার ৬৫৪ জন।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৫৪ হাজার ৩৩১ জন। ঢাকায় ২৯ হাজার ৬০২ এবং ঢাকার বাইরে ২৪ হাজার ৭২৯ জন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান ও আবাসিক চিকিৎসক (আরপি) সহকারী অধ্যাপক ডা. তৌফিক আহমেদকে সদস্যসচিব করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি-২০২৩ গঠন করা হয়েছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ডেঙ্গুবিরোধী সামাজিক আন্দোলন চাই নামে একটি সংগঠন।
এ কমিটিতে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে প্রধান উপদেষ্টা, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেনকে বিশেষ উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে উপদেষ্টা পদে মনোনীত করা হয়েছে।
এ সময় উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ডেঙ্গু প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠার উদ্যোগটি ভালো। এ জন্য মানুষকে সচেতন করতে আমাদের সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, এখন ডেঙ্গুর ধরন পাল্টেছে। আগে দিনে মশা কামড়াত, এখন ২৪ ঘণ্টাই কামড়ায়। আগে পরিষ্কার পানিতে মশার লার্ভা পাওয়া যেত, এখন ময়লা পানিতেও পাওয়া যায়।’
উপাচার্য বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করে তা তৈরি করার ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নেব।’
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।