দেশে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নির্মাণ সামগ্রীর দাম। শুধু রডের দামেই গেল এক বছরে এই হার টনপ্রতি প্রায় ২০ শতাংশ। সিমেন্টের দামেও প্রায় একই ধারা। এর প্রভাব পড়ছে দেশের নির্মাণ শিল্পে। ব্যক্তি-উদ্যোগে পাকা স্থাপনা নির্মাণেও ব্যয় বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তার তাই অত্যাবশ্যক নির্মাণ পণ্য রড ও সিমেন্টের দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন। আমদানিকারক ও উৎপাদকদের চিঠি দিয়ে তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানটি।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গেল ৩১ আগস্ট সংশ্লিষ্টদের বরাবরে দেয়া এই চিঠি দিয়ে তিন কার্যদিবসের মধ্যে ১১ ধরনের তথ্য দিতে বলা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, মূলত দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করা হবে। এক্ষেত্রে আমদানি, শুল্ক হার, উৎপাদন ব্যয়সহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে মূল্য নির্ধারণ করা হতে পারে। অত্যাবশকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬ অনুযায়ী সিমেন্ট ও রড একটি অত্যাবশকীয় পণ্য। এই আইনবলেই তথ্য চেয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
এদিকে ব্যবসায়িরা বলছেন, এখনো তারা লস দিয়ে ব্যবসা করছেন। তাই দাম আরো বাড়ানোর পক্ষে তারা। অপরদিকে ভোক্তারা বলছেন, চাইলেই এদেশে দাম বাড়িয়ে দিতে পারছে অসাধু ব্যবসায়িরা। সুযোগ বুঝে লুটে নিচ্ছে টাকা। এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের গাফলতিকেই দুষছেন তারা।
বাংলাদেশ স্টিল মিলস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও শাহরিয়ার স্টিল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশন যেসব তথ্য চেয়েছে সেসব পর্যালোচনা করলে রডের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ আমরা লোকসান দিয়ে ব্যবসা করছি। আমদানি ঋণপত্র খোলার ৬ মাস পর পেমেন্ট করি। আমরা ৮৫ টাকা ডলারের সময় এলসি খুলেছিলাম। এখন সেই ডলার শোধ করতে হচ্ছে ১১০ টাকা দরে। সারাবিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে উৎপাদন কম হচ্ছে। এর মধ্যে ডলার বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ায় ব্যাংকে এলসিও খোলা যায়নি। এসব কারণে কাঁচামালের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।’
আন্তর্জাতিক বাজারের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে মাসাদুল আলম বলেন, ‘ইচ্ছা করলেই দাম বাড়ানো যায় না। ডলারের দাম এখন কমলেও ১০০ টাকার নিচে নামবে না। সারা বিশ্বেই অস্থির অবস্থা। মূল্য সমন্বয় না করলে ব্যবসা করা কঠিন হবে।’
কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, ‘রড ও সিমেন্টর দাম বেড়েই চলেছে। এই দুই পণ্যের মূল্য যৌক্তিকভাবে বাড়ছে কিনা তা কেউ দেখছে না। এক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি তদারকির আওতায় আনা দরকার। তা না হলে ভোক্তাদের ওপর ব্যয়ের চাপ বাড়বে।’
জানা গেছে, অত্যাবশকীয় আইন, ১৯৫৬ এর ৩ ধারা ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সংশোধন আইন, ২০২০ এর ৭(২)গ ধারা অনুযায়ী মূল্য পর্যালোচনার জন্য সিমেন্টের তথ্য চাওয়া হয়েছে। রড ও সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল (স্থানীয় ও আমদানি করা) আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক হার, জুলাই ও আগস্ট মাসে কাঁচামাল আমদানি সংক্রান্ত এক্স বন্ড কপি জমা দিতে বলেছে কমিশন। এছাড়া আগস্টে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (ঋণপত্র) খোলা সংক্রান্ত তথ্যও চাওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কপি যুক্ত করতে হবে।
উৎপাদন ব্যয় বিবরণী এক্সেল ফরম্যাটে জমা দেয়া ছাড়াও ভ্যাট সংক্রান্ত ইনপুট আউটপুট কো-ইফিসিয়েন্ট তথ্য, উৎপাদন-পরবর্তী সাপ্লাই চেইনে থাকা মুনাফা ও এ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র, কোম্পানির সবশেষ সার্টিফাইড নিরীক্ষা প্রতিবেদন বা অডিট রিপোর্টও জমা দিতে হবে।
চিঠিতে উৎপাদন পদ্ধতির ফ্লো চার্ট, সবশেষ রপ্তানি সংক্রান্ত ইএক্সপির কপি এবং সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তার নাম চেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও পৃথকভাবে সিমেন্ট উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের নাম ধরে তথ্য চেয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
অপরদিকে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও ১৮টি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের কাছে রড উৎপাদনের তথ্য চেয়েছে নিয়ন্ত্রক এই প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এক বছরে রডের দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে এতটা বেশি পরিমাণে রডের দাম আর কখনোই বাড়েনি। বাজারভেদে বর্তমানে এক টন রড ৯৩ থেকে ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিছুদিন আগে তা ছিল ৮৬ থেকে ৮৭ হাজার টাকা। দেশে রি-রোলিং মিলের সংখ্যা প্রায় ১৩০টি। এর মধ্যে বড় আকারের ৫০টি। বাকিগুলো ছোট ও মাঝারি আকারের। মিল মালিকদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বার্ষিক রডের চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন। এর ৬০ শতাংশই সরকারি উন্নয়ন কাজে ব্যবহার হয়। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ বেসরকারি খাতে।
মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রডের কাঁচামালের আমদানি ব্যয় অনেকটা বেড়ে গেছে। ডলার সংকটের কারণে নতুন ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
রডের প্রধান কাঁচামাল পুরনো লোহালক্কড় বা স্ক্র্যাপ আমদানি করে বিলেট তৈরি করে তা রি-রোলিং মিলে গলিয়ে রড তৈরি করা হয়। ৮০ শতাংশ স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়। বাকি ৩০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় অভ্যন্তরীণভাবে। ভাঙারি ব্যবসায়ী ও পুরনো জাহাজ কেটে তা থেকে স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা হয়। আগে প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে কাঁচামাল স্ক্র্যাপের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হতো। ডলার সংকটের কারণে সেটি ১১০ টাকায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ৪০০ থেকে ৪৫০ ডলারে গিয়ে ঠেকে। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫০ ডলার।
রড বিক্রি আগের তুলনায় কমে গেছে জানিয়ে শাহরিয়ার স্টিল মিলস লিমিটেডের এমডি শেখ মাসাদুল আলম বলেন, ‘ঠিকাদাররা আগের দামে কাজ করছেন না। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এবং পণ্যের দাম পুনর্মূল্যায়ন না হলে ব্যবসায় লোকসান হবে। এতদিনের লোকসান পুষিয়ে নেয়াও কঠিন। সরকারি সব আগের প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে। নতুন কোনো প্রকল্প নেয়া হচ্ছে না। ফলে রডের চাহিদা কমে গেছে।’
অপরদিকে সিমেন্টের দাম প্রতি বস্তায় বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম কোম্পানিভেদে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা। কিছুদিন আগেও তা ছিল ৪৯০ থেকে ৫০০ টাকা। সিমেন্ট তৈরিতে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করা। এর পুরোটাই আমদানিনির্ভর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টন সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছ। এতে খরচ পড়েছে ১৫৪ কোটি ডলার। দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী ৪০টি প্রতিষ্ঠান এই কাঁচামাল আমদানি করেছে। কোম্পানিভেদে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানি বাড়লেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই আমদানি কমেছে। কাঁচামাল আমদানি কমে এলেও খরচ বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
সূত্র : দৈনিক আমার বার্তা