বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ ছাত্রছাত্রী পাশ করেন। এর প্রধান কারণ, দেশে প্রতিনিয়তই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের জন্য এটা একটা ভালো দিক বটে। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। তাই উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশই এখন বেকার রয়ে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এক্ষেত্রে চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এর কারণ, চাকরির বাজারে চাহিদা অনুযায়ী জনবল আমরা তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতিবছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হতে চাচ্ছেন, তাদের উপযোগী চাকরি নেই বলে অনেকে মনে করেন। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী শহরের শোভনীয় কাজ করতে পছন্দ করেন। তবে দেশে বর্তমানে চাকরির সুযোগ বাড়ছে দুটি খাতে, যথা-কৃষি ও উৎপাদনশীল খাতে। এসব খাতে কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু শিক্ষিত যুবকরা এসব কাজে নিজেদের যুক্ত করতে চান না। এদিকে বিশ্বে করোনা মহামারির কারণে দেশের ব্যবসা খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে যেসব শিক্ষিত যুবক ছোটখাটো ব্যবসার মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত ছিলেন, তারাও বেকার হয়ে পড়েছেন। এসব ছোট উদ্যোক্তার হাতে সরকারের দেওয়া প্রণোদনার অর্থও খুব একটা পৌঁছায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, করোনার দোহাই দিয়ে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শত শত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনা নোটিশে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ইউজিসি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি।

সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করে না। এত বৈষম্য কেন? ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষিত হওয়া তরুণ-তরুণীদের সনদ থাকা সত্ত্বেও চাকরি হচ্ছে না। বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের পছন্দের চাকরির জায়গায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। একসময় শিক্ষিত তরুণরা ভালো বেতনের আশায় বেসরকারি চাকরির প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিল। এখন হয়েছে ঠিক এর উলটা। এক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে যেভাবে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে, বেসরকারি খাত সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখন মেধাবী ও শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেসরকারি চাকরির বদলে সরকারি চাকরিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ কারণে তারা সরকারি চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর এ সময়টাতে স্বেচ্ছায় বেকার থাকার পথকে বেছে নিয়েছে তারা। এর ফলে শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো নিকৃষ্ট কাজের অভিযোগ পাওয়া যায় অহরহ। আর এসব নিকৃষ্ট কাজে জাতির আলোকবর্তিকারা অর্থাৎ শিক্ষকসমাজ জড়িত থাকে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া যায়। এমনকি কিছু সংখ্যক শিক্ষক বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হন। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুরো শিক্ষকসমাজ। তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আজ কলুষিত হচ্ছে মহান পেশার অতীতের গৌরব ও মর্যাদা।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা ৩০ বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। পরে সেশনজটের কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২৭-এর পরিবর্তে ৩০ বছর করা হয়। ২০১১ সালে এসে অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করা হয় এবং মহান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ৬০ বছর নির্ধারণ করা হয়। অবসরের এ দুই-তিন বছর বৃদ্ধির কারণে ওই সময় তেমন কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। তথাপি ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ ৩০ বছরে গড় আয়ু বাড়িয়ে ৭৩ বছর করা হয়েছে; কিন্তু চাকরিতে প্রবেশসীমার বয়স বাড়েনি। এক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এদিকে চিকিৎসকদের শিক্ষাজীবন বেশি দিনের হওয়ার কারণে তাদের চাকরির আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর করা হয়েছে। এছাড়া কোটার আওতাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য চাকরির বয়সসীমাও ৩২ বছর করা হয়েছে। আমাদের দেশে এমনিতেও বেকারত্বের হার অনেক বেশি। এর কারণ বেকারত্ব দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বা সার্বিক উন্নয়নের একটি বড় বাধা। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় সংকট। এদিকে পরিস্থিতির তো উন্নতি হয়নি বরং যারা শিক্ষিত, তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম। এ মুহূর্তেু দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবটা লক্ষ করা যায়। তাছাড়া শিক্ষিত বেকারত্বের হার সামনে আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর কারণ, শিক্ষার যে মান, সেটা আমাদের বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি দিতে পারছে না। এমনিতেই করোনার কারণে যেটুকুই পড়াশোনা হতো সেটাও হয়নি। বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের চিত্র শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সারা বিশ্বেই করোনার সময় থেকেই শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-ট্রেন্ডস ২০২২’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে করোনা মহামারির শুরুর আগের বছরের তুলনায় করোনা-পরবর্তী সময়ে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১০ লাখের বেশি। অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা বলেন, প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ উচ্চশিক্ষিত হতে পারে। তবে শিক্ষিতদের বড় একটি অংশ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এদিকে দক্ষ কারিগরি ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত জনবলের অভাবে সরকারি শূন্যপদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে প্রচলিত ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাকরি পেতে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা আরও বলেন, শিক্ষিত বেকাররা চাকরি না পাওয়ায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর ফলে শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত জনবলকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত করা যাচ্ছে না। আর চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকে বেকারদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ডে। অন্যদিকে চাকরি না পাওয়ার কারণে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের একটি অংশ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ফলে তাদের মেধা ও সেবা দেশের কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তবে যারা স্বল্পশিক্ষিত তাদের মধ্যে বেকারত্বের সংখ্যা কম। এর কারণ, তারা যে কোনো ধরনের কাজ করতে পারে। কিন্তু উচ্চশিক্ষিতদের এখানেই যত আপত্তি। এর ফলে উচ্চশিক্ষিতের হার বৃদ্ধি মানে বেকারত্বের হারও বেড়ে যাওয়া। তবে এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণা এখন পর্যন্ত হয়নি। ভবিষ্যতে কী ধরনের চাকরির চাহিদা তৈরি হবে এবং কী ধরনের শিক্ষিত মানুষ প্রয়োজন, সে বিষয়ে পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে। বিশেষত আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষার মান উন্নত না হলে দেশ অনেক পিছিয়ে পড়বে। এর জন্য একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির নামে বেকারত্ব না বাড়িয়ে চাহিদানির্ভর শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। উল্লেখ্য, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ বা ইংরেজিতে বা ইতিহাসে যে বিষয়ে পড়াশোনা করুক না কেন, সব শিক্ষার্থীকে যে কোনো একটি কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমনকি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট দিতে পারে যে, সবাই যেন প্রতিবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘ফ্রেশ’ গ্র্যাজুয়েটকে তিন থেকে ছয় মাসের জন্য ইন্টার্নশিপ হিসাবে নিয়োগ দেয়। অর্থাৎ ‘অন দ্য জব’ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এতে চাকরির সুযোগ বাড়বে। এজন্য একটি নীতিমালা করা যেতে পারে। সরকারকে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর বেকারত্ব সমস্যা নিরসনে আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং সেই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন যেভাবে হচ্ছে, তাতে বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি উন্নত না হলে ভবিষ্যতে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব। এ কারণে কারিগরি শিক্ষার মান ও সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবলের অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার মতোই মূল্যায়ন করতে হবে। চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি বা বেসরকারি অভিজ্ঞতার কোনো ভেদাভেদ রাখা যাবে না। এ বিষয়টি ইউজিসিকে নিশ্চিত করতে হবে। যতদূর জানা যায়, বিশ্বের ১৯২টি দেশের চাকরির প্রবেশের বয়সসীমার মধ্যে ১৫৫টি দেশের চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৫৫ বছর। আবার কোথাও কোথাও বয়সসীমা ৫৯ বছর পর্যন্তু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকায় ৫৯ বছরেও একজন নাগরিক সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। এমনকি শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়ায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোয় চাকরির বয়সসীমা ৩০-এর ঊর্ধ্বে হওয়ার কারণেই এত উন্নত হয়েছে। আমাদের দেশে চাকরির বয়সসীমা কিছুটা শিথিল করা যেতে পারে। এদিকে চাকরির পরীক্ষায় কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি যাতে না ঘটে সে বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এর পাশপাশি বিভিন্ন পদের পরীক্ষা একই সময়ে যেন না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এমনকি চাকরির আবেদন ফি কমিয়ে সহনীয় পর্যায় রাখা যেতে পারে। জাতীয় স্বার্থে বেকারমুক্ত দেশ গড়তে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধাকে যথাযথ মূল্যায়ন করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম