লঘুচাপ আর পূর্ণিমার আগাম প্রভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর। কয়েকদিন ধরে চলছে এই অবস্থা। এ কারণে ইতোমধ্যে দেশের চার সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সাগরের এই পরিস্থিতির আঁচ লেগেছে দেশের উপকূলীয় অন্তত ১৫ জেলায়। ইতোমধ্যে এসব জেলার নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ ২ থেকে ৪ ফুট বেড়েছে। ফলে বেশিরভাগ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গিয়েছিলেন হাজার হাজার জেলে। কিন্তু তাদের মাছ না ধরেই ফিরে আসতে হয়েছে। মঙ্গল ও বুধবার উত্তাল বঙ্গোপসাগরে পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও ভোলার ছয়টি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে। ৭৫ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৯ জন নিখোঁজ ছিলেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানান, ওড়িশা উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি নিম্নচাপ অবস্থান করছিল। সেটি পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে দুর্বল হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এটি ভারতের ছত্তিশগড় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর-পশ্চিমদিকে অগ্রসর হতে পারে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে। সমুদ্রবন্দরসমূহ, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার সব নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
বিএমডি জানায়, লঘুচাপ আর বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২-৪ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।
অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে বরিশালে কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপরে। তেঁতুলিয়া নদীর পানি ভোলা খেয়াঘাট এলাকায় ৩০ সেন্টিমিটার ওপরে। একইসঙ্গে তজুমদ্দিন উপজেলার মেঘনা নদীর পানি ৮৭ সেন্টিমিটার ওপরে, পটুয়াখালীতে মির্জাগঞ্জ উপজেলার বুড়িশ্বর/পায়রা নদীর পানি ২৯ সেন্টিমিটার ওপরে, ঝালকাঠিতে বিশখালী নদীর পানি ১৯ সেন্টিমিটার আর বরগুনায় বিশখালী নদীর পানি ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে অন্যান্য নদীরও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে বুধবার সকাল থেকে কয়েক দফা বৃষ্টি হয়। তবে সামান্য সময়ের মধ্যে তা আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। এছাড়া সারাদিনই আকাশ ছিল মেঘলা। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিকাল থেকে ভ্যাপসা গরম অনুভূত হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শেখ ফরিদ আহমদ বলেন, উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক ছিল।
চরফ্যাশন (ভোলা) : অশনির প্রভাবে রোববার রাত থেকেই বৃষ্টি শুরু হয় উপকূলে, যা টানা চলতে থাকে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত। এরপর রাতে বিরতি দিয়ে বুধবার সকালে আবার বৃষ্টি শুরু হয়। গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেরা তাদের মাছধরা ট্রলার নিয়ে নিকটবর্তী মাছ ঘাটে আশ্রয় নিয়েছে।
কাউখালী (পিরোজপুর) : কাউখালীতে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। এসব এলাকার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে পানি প্রবেশ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পানিতে নিম্নাঞ্চলে রবিশস্য, উফশী ফসল ও আমনের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বরগুনা : নিম্নচাপের ফলে সাগর উত্তাল থাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরেছে শত শত মাছ ধরার ট্রলার। তবে পাথরঘাটা উপজেলার দক্ষিণে বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর মোহনায় জেলেবিহীন ভাসতে দেখা গেছে মাছ ধরা একটি ট্রলার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী।
রাঙ্গাবালী ও কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) : উত্তাল বঙ্গোপসাগরে ৩৩ মাঝিমাল্লা নিয়ে রাঙ্গাবালীর তিনটি জেলে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। সোমবার রাতে সাগরে এ ট্রলারডুবির পর ৩১ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাকি দুই জেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারা হলেন রাঙ্গাবালীর মৌডুবি ইউনিয়নের মাঝিকান্দা গ্রামের মনতাজ মুন্সির ছেলে সিরাজুল ইসলাম ও গলাচিপা উপজেলার গজালিয়া গ্রামের আফসার মোল্লার ছেলে সিদ্দিক মোল্লা।
ভোলা : বুধবার সকাল ৯টা থেকে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। কোস্টগার্ডের দক্ষিণ জোনের অপারেশন অফিসার সৈয়দ তৈমুর পাশা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, মঙ্গল ও বুধবার সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে ভোলার দৌলতখানের ও ঢাল চরের দুটি, নোয়াখালী জলার হাতিয়া অঞ্চলের একটি ট্রলার ডুবে যায়। এসব ঘটনায় ৪৪ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে ১৭ জেলে। তাদের সন্ধানে কোস্টগার্ডের একটি টিম কাজ করছে।