আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একজন নার্সের দেহে প্রথম টিকা দেওয়া হবে। এ জন্য প্রস্তুত করা হয় হাসপাতালকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি টিকা দেওয়ার কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। এরই মধ্যে দেশে এসেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ৭০ লাখ চার হাজার ডোজ ‘কোভিশিল্ড’ টিকা। প্রথমে ২০ জানুয়ারি এসেছে ভারত সরকারের পাঠানো ২০ লাখ চার হাজার ডোজ উপহারের টিকা এবং গত সোমবার এসেছে সরকারি টাকায় কেনা তিন কোটি টিকার প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ।
টিকা নেওয়ার জন্য সবাইকে আগে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে হবে নতুন তৈরি করা সুরক্ষা অ্যাপসের মাধ্যমে। আজ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী টিকা প্রদান উদ্বোধন করার পরপরই সবার জন্য চালু হবে সুরক্ষা অ্যাপস। আজ উদ্বোধনী পর্বে টিকা দেওয়া হবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২৫ জনকে। কাল থেকে ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে তালিকাভুক্ত প্রায় ৫০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে পাইলট রান বা পর্যবেক্ষণের জন্য টিকা দেওয়া হবে। টিকা দেওয়ার আগে প্রত্যেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে।
এরই মধ্যে অক্সফোর্ডের টিকা ব্যবহারের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গতকাল মঙ্গলবার অধিদপ্তরের ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবে ভারত থেকে আসা টিকার কাগজপত্র, তাপমাত্রা ও ভায়েলের অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে টিকা দেশের মানুষের শরীরে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এদিকে কাল থেকে ঢাকার পাঁচ হাসপাতালে টিকা দেওয়া ও পর্যবেক্ষণের পর আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে টিকা দেওয়া শুরু হবে সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে। প্রথমে অগ্রাধিকার পাবেন করোনা মোকাবেলার সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিক এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীর তালিকাভুক্তরা। পর্যায়ক্রমে টিকা পাবে অন্যরা।
কুর্মিটোলা হাসপাতালে টিকার উদ্বোধনী পর্বের আয়োজনের প্রস্তুতি দেখতে এসে গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি টিকাদান পর্ব উদ্বোধন করবেন। প্রথমে একজন নার্সসহ কুর্মিটোলা হাসপাতালের পাঁচ স্বাস্থ্যকর্মী টিকা নেবেন। এরপর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আরো ২০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। পরের দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের প্রায় ৫০০ চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেওয়া হবে। তাঁদের সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে টিকা দেওয়ার মূল কার্যক্রম শুরু হবে। মন্ত্রী বলেন, টিকা দেওয়ার জন্য নিবন্ধন অ্যাপস চালু হবে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরপরই। উদ্বোধনী পর্বে যাঁদের টিকা দেওয়া হবে, তাঁদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তিনি বলেন, ‘টিকা নিয়ে কোনো অপপ্রচার বা গুজবের সুযোগ নেই।’
আজ কুর্মিটোলা হাসপাতালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানস্থলে সরকারি মিডিয়া ছাড়া কোনো বেসরকারি গণমাধ্যমকে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিটিভি, বেতার ভেতরে থাকবে, অন্যরা বাইরে থাকতে পারবে। টেলিভিশনগুলো বিটিভি থেকে সম্প্রচার করতে পারবে। সাংবাদিকরা এই বিষয়ে আপত্তি জানালে মন্ত্রী বলেন ‘অনুষ্ঠানের পরে আমি বাইরে এসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব এবং দেখি বাইরে একটি বড় পর্দার ব্যবস্থা করা যায় কি না।’ পরে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আবারও মন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে—যেহেতু অনুষ্ঠানস্থলে প্রধানমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত হবেন না, তাই সেখানে সব গণমাধ্যমকে রাখার ব্যবস্থা করার জন্য।
এদিকে গতকাল সকালে রাজধানীর মহাখালীতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে সংস্থাটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘গত সোমবার ভারত থেকে আসা ৫০ লাখ টিকার ব্যাচভিত্তিক নমুনা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সব কিছু ঠিকঠাক পাওয়া গেছে। ফলে আমরা এই টিকা বাংলাদেশের মানুষের জন্য ব্যবহারের উপযোগী বলে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছি। তবে আগে উপহারের আসা ২০ লাখ টিকা এখনো পরীক্ষা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের বিশ্বখ্যাত সেরাম ইনস্টিটিউটে এই টিকার উৎপাদন হলেও এটি ভারতীয় কোনো টিকা নয়। এটি তৈরি হয়েছে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায়। এর মান নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই।’
আজ কুর্মিটোলা হাসপাতালে প্রথম যাঁকে টিকা দেওয়া হবে তাঁর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, তিনজন নার্সকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে যে কাউকে প্রথম টিকাটি দেওয়া হবে। কে আগে টিকা পাবেন, সেটি তিনজনের কাউকেই জানানো হয়নি। নানা কারণে বিষয়টি নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। এ সত্ত্বেও গতকাল আলোচনায় আসে রুনু ডি কস্তা নামে একজন নার্স প্রথম টিকাটি নেবেন। এই হাসপাতালের আরো দুজন চিকিৎসককেও টিকা দেওয়া হবে আজ। তাঁদেরও নাম যাতে প্রকাশ না পায়, এমনকি তাঁরা নিজেরাও যেন টিকা দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত জানতে না পারেন সে জন্য আরো কয়েকজনকে একসঙ্গে টিকা দেওয়ার স্থানে উপস্থিত রাখা হবে।
এ ছাড়া আজ অন্য শ্রেণি-পেশার যে ২০ জনকে টিকা দেওয়া হবে, তাঁদের তালিকাও গোপন রাখা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত তাঁদের কিছুই জানানো হয়নি। আজ সকালে তাঁদেরকে কুর্মিটোলায় উপস্থিত থাকতে বলা হবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
টিকা দেশে আসার পরে তালিকার কাজ শুরু করার পর অনেকেই এতে সাড়া দিতে চাননি। এমনকি নিবন্ধনের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তালিকা চাইলেও অনেকেই নাম দেননি। কিন্তু দুই দিন ধরে হঠাৎ করেই প্রথম ২৫ জনের মধ্যে নিজের নাম রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে তদবির শুরু করেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী যতক্ষণ অনলাইনে থাকবেন, ওই সময়ের মধ্যে যাতে টিকা নিতে পারেন সে জন্য অনুরোধ করছেন বলেও জানা গেছে। এমন ব্যক্তিদের মধ্যে চিকিৎসক ও সাংবাদিক নেতাও রয়েছেন। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে আজ টিকা দেওয়ার তালিকায় একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, একজন অভিনেতা ও একজন রাজনীতিবিদ থাকতে পারেন। এমনকি একজন মন্ত্রী ও এমপির থাকা নিয়েও গতকাল সন্ধ্যার পর তথ্য পাওয়া যায়। তাঁদের নাম পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়ায় প্রকাশ করা হলো না।
কুর্মিটোলা হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে যাঁদের টিকা দেওয়া হবে, প্রথমে তাঁদের একটি নির্ধারিত জায়গায় বসানো হবে। পরে বিশেষ মেডিক্যাল টিমের সদস্যরা একে একে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন, রোগসংক্রান্ত ইতিহাস শুনবেন। এরপর যদি টিকা দেওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন, তখনই শুধু তাঁর নাম নিবন্ধন করা হবে এবং তাঁকে নেওয়া হবে টিকা দেওয়ার নির্দিষ্ট বুথে। টিকা দেওয়ার পর এক ঘণ্টা তাঁকে হাসপাতালেই পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এই সময়ের মধ্যে যদি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না দেয়, তাহলে তাঁকে বাসায় যেতে দেওয়া হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তার মাত্রা অনুসারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য চিকিৎসকদল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
কুর্মিটোলা ছাড়াও কাল থেকে আরো যে চারটি হাসপাতালে টিকা দেওয়া শুরু হবে পাইলট আকারে, সেই হাসপাতালগুলোও প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমাদের ১০০ জন চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেওয়া হবে। তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনমতো চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. রওশান আনোয়ার বলেন, ‘আমাদের এখানে ৬৪ জনকে পর্যবেক্ষণের আওতায় টিকা দেওয়া হবে। হাসপাতালের তিনতলায় এই টিকাদান কার্যক্রম চলবে। এ জন্য তিন স্তরের কক্ষ সাজানো হয়েছে। যাঁরা টিকা দেবেন, তাঁদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সবাই এখন প্রস্তুত বৃহস্পতিবারের জন্য।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সবার আগে টিকা দেওয়া শুরু হবে ঢাকায়। সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটায় টিকা বণ্টনের ক্ষেত্রেও সবার আগে প্রাধান্য পাবে ঢাকা। কোথায় কত টিকা যাবে সেই তালিকাও চূড়ান্ত হয়েছে। সে অনুসারে প্রথমে আসা ৫০ লাখ ডোজ টিকা থেকে ঢাকা জেলায় থাকবে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডোজ। জেলা পর্যায়ের প্রতিটি হাসপাতালের সংরক্ষিত ‘কোল্ড রুমে’ প্রায় চার লাখ ২৫ হাজার ডোজ টিকা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালে পাঁচ থেকে ১০টি আইস ফ্রিজার আছে, যেখানে অন্তত ৭১ হাজার ডোজ টিকা রাখা যাবে। প্রাথমিকভাবে সারা দেশে বর্তমানে সাত হাজার ৩৪৪টি টিম টিকা দেওয়ার কাজ করবে। প্রতিটি টিমে ছয়জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কঠোরভাবে বিষয়টি মনিটর করবে। টিকাসংক্রান্ত সব তথ্য যেন মানুষ দ্রুত জানতে পারে সে জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিয়মিত ‘ভ্যাকসিন বুলেটিন’ প্রচার করা হবে। টিকা দেওয়ার জন্য ৪২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
দৈনিক সময়ের সংবাদ.কম প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।